Saturday 21 January 2012

দূরের নক্ষত্র

রকাশিত হল 'দূরের নক্ষত্র'-নন্দিতা ভট্টাচার্য'র
বাংলা কবিতা সংকলন ।
প্রকাশক ~~ভাষা সংসদ।
পাওয়া যাবে বইমেলায় । 'প্যাপিরাস' ,'অহর্নিশ' ,'অনুবাদ পত্রিকা' ,'কারুভাষ' ~র স্টলে ।

Wednesday 18 January 2012

উরুকার রাত ,ভোগালি বিহু~~পৌষসংক্রান্তি



পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত । আসামে  বলে উরুকা । সেই রাতের জন্য হা পিত্যেস করে বসে থাকতাম আমরা সারা বছর  । এক মাস /পনের দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যেত তোড়জোড় । ভেলাঘর তৈরি করার সাজসরঞ্জাম জোগাড় করা চলত অনেকদিন ধরে । শহরে সব কিছুই সংগ্রহ করা বেশ কষ্টকর। কিন্তু ভেলাঘর তৈরি করতে চাই খড় ,বাশ, কলার শুকনো পাতা বা পাচালি। বাঁশ দিয়ে ঘরের খাঁচাটি তৈরি হবে, চাল হবে খড়ের, দেয়াল হবে কলার পাচালি দিয়ে । পাশে হবে মেজি। বিশাল খোলা মাঠে  তৈরি হত । ছেলেদের মধ্যে এই নিয়ে  দারুন প্রতিযোগিতা ।কার ভেলাঘর কত বড়।কার মেজি কত উঁচু ।  মেজি খড় বা কাঠ দিয়ে  তৈরি হত । সিলেটে বলা হত মেড়ামেড়ি। দাদাদের ভেলাঘর ও মেজি ঘর বিশাল কাণ্ডকারখানা ।আমাদের ছোটখাট ব্যাপার  । ছোট্ট একটুখানি ঘর ।মেঝেতে খড় পাতা  ।তাতে হুটপাটি দাপাদাপি ।চেঁচিয়ে গান গাওয়া ,কত রকমের গল্প । বন্ধুদের একসঙ্গে এতক্ষন থাকা ।রাতের  পিকনিকের তোড়জোড় ।
 সেদিন টি ছিল চুরিরও রাত। কারোর বাড়ির পাঁচিল বেড়াটি আস্ত থাকতো না ।গোটা বাঁশের বেড়া  হই হই করে তুলে নেয়া হত। এ ছাড়া ফল, সবজি, মুরগি,হাঁস সবই চুরি হত ।    তারপর এল খাওয়াদাওয়া  ।সে কি আনন্দ।নিজের হাতে রান্না করে খাওয়া।রান্নাবাটি খেলা । দাদারা ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলত । আমাদের এর ওর কাছ থেকে চেয়ে চিনতে  সব্জি ,ডিম ,চাল  যোগাড় করা । কখন কখন মুরগির মাংস হত ।নিষিদ্ধ  মাংস । তারপর আবার কায়স্থ বামুনে মাখামাখি । ঠাকুমাকে পুরো ব্যাপারটাই চেপে দেয়া হত ।   মেয়ে বলে খাওয়ার পর বাড়ি ফেরা।রাতে থাকা চলবে না । ছেলেদের অবশ্য সে সব নেই।তাই দাদারা সারারাত ভেলাঘরে থাকত। আমাদের মন খারাপ হত ।ইচ্ছে করত সারারাত বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে কাটাই । তা আর কোথায় । তাই গুটি গুটি পায়ে ঘরে ফেরা ।  পরদিন সক্কাল বেলা চান করেই দৌড় ভেলা ঘরে ।এবার এতদিনে তৈরি করা প্রিয় ঘরটি জ্বালিয়ে দিতে হবে, তাই নিয়ম। ভোরবেলা সূর্য উঠছে আর দিকে দিকে মেজি , ভেলা ঘর পুড়ছে ।আগুন আর সূর্যদেব চোখাচোখি। পৌষের প্রচণ্ড শীতের সকালে কি আরাম !  ভেলাঘরের চারপাশ ঘিরে মা দের রাতের তৈরী পিঠে খাওয়া । মেজি ঘর জ্বালাবার সময় তিলপিঠে পান-তাম্বুল ও পয়সা দেয়া হত । আগুনকে  ঘিরে  চলত পিঠে খাওয়ার ধুম । গ্রামে এই মেজির পোড়া ছাই ক্ষেতের মাটিতে ছড়িয়ে দেয়া হত। বিশ্বাস তাতে মাটি উর্বর হয়।  আগামি বছরের আরও ভাল ফসলের আশায় ।কারন বিহু আসলে ফসল কাটা ,পুর্ন ভাণ্ডারের  উৎসব। ভোগালি বিহু ভোগের নতুন চালের উৎসব ।যেমন বাংলায় পৌষ  সংক্রান্তি  । মাটির গান। হারভেস্টিং সং । আর আগুন জ্বালিয়ে আসলে অগ্নি উপাসনা করা হয় । তাকে খুশি রাখা । সে আবার অন্য গল্প । আর্য্য প্রভুদের কথা । তারপর সংক্রান্তির দিন সারাদিন হইহুল্লোড় খাওয়া দাওয়া আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে পিঠে পাঠানো বা গিয়ে গিয়ে পিঠে খাওয়া ।যেহেতু তিল সংক্রান্তি তাই তিল পিঠের খুব চল ছিল আসামে এ ছাড়া ছিল ঘিলাপিঠা ,ভাতপিঠা ,খোলাপিঠা ,বরপিঠা।বরাচালের গুড়ি বানিয়ে ভাজা হত ,তাকে বলা হত 'হুরুম' । এ ছাড়া বিরনির চাল। পশ্চিমবঙ্গে এই চাল  দেখিনি । বাশের চোঙ্গের ভেতর অল্প জল দিয়ে উনুনে পোড়ান হত। তাকে বলা হত চুঙ্গাপিঠা ,  খুব জমাট বাধা  দই দিয়ে খাওয়ার রেয়াজ সেটা । এ ছড়া অসমীয়া সমাজে নতুন চালের পিঠা ,তিলের পিঠা, নতুন আলু খাওয়া হয়। আলু না খেলে নাকি পরের জন্মে শুয়োর হয়ে জন্মাতে হবে তেমন বিশ্বাসও আছে গ্রামে গঞ্জে ,মানে এতটাই আলুর মাহাত্ম্য । কারন নতুন আলুতো তখন ভরপুর ।মাছ ,মাংস ,বিশেষত চিতল মাছ খাওয়া হত । তেমনি আসামে থাকা বাঙ্গালীরা বিহু যেমন পালন করতেন পরেরদিন পৌষ  সংক্রান্তি পালিত হত মহা ধুমধাম করে ।বাঙ্গালিদের বাড়িতে হত পাটিসাপটা ,দুধপুলি ,চন্দ্রপুলি ,ছোলারপিঠে ,মুগসলই, জামপিঠে,গোকুল পিঠে ,এলঝেল  আর কত !!দুটো অনুষ্ঠানই গা জড়াজড়ি করে চলত । উৎসবমুখর হয়ে উঠত পরিবেশ ।ভালবাসার আবহটি ও গড়ে উঠত, মজবুত হত  সম্পর্ক । ভোগালি বিহু ও পৌষ সংক্রান্তি ,বড় আদরের ও অপেক্ষার উৎসব । কৃষকের কোলভরা ,মনভরা উৎসব ।

Friday 6 January 2012

আলাপ ~~~~

 
                                                                 
আলজিভে বানিজ্য , জিভে কবিতা
ঠোঁটে ভালবাসা ।
লক্ষ্মী কবিতার গোঁড়ায় বিষ ,
মনের ভেতর গর গর অন্য
এক রেয়াজ, সহজ সরগম
অনেকদূর ,আলজিভ জিভ
গড়িয়ে ঠোঁটে নামুক অমৃত
রাগিণী জলাধার ।

লোকাল লেডিস কামরা~~~~~~~~~~~~~~~


ঐ আসছে ক্যাটারপিলার !কোমর দোলাতে দোলাতে । রোজদিন  রিয়া টেনশন ফ্রি  হয় এ ভাবে !! এরপর তো যুদ্ধ শুরু । ঐ এল । ওঠা গেলো  । মহিলা কামরা । একটি  ছোটখাটো প্রমিলা রাজ্য বল্লেও কম বলা হয় ।  আপাত শ্রেণি বিভাজন আছে কিন্তু আধিপত্য উচ্চবর্গের হাতে নেই। স্কুলের দিদিমনিরা সংখ্যায় বেশী। নরেন্দ্রপুর ,গড়িয়া , থেকে বনগাঁ  , কৃষ্ণনগর   ,ডানকুনি । কোথায় নয়? উত্তর থেকে দক্ষিন , পুব থেকে পশ্চিম ;  মেন থকে কর্ড সব লাইন । কখনো গঙ্গা পেরিয়ে ,কখন  ভ্যান  রিক্সায় , ট্রেনের আগু পিছু সব কিছু চেপে হাঁপাতে হাঁপাতে  ট্রেন ধরা ।  তবুও  যথেষ্ট সেজেগুজে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসেন । পোশাক নিয়ে অনেক হাল্লা চিল্লা পেরোতে হয়েছে তাদের । কেউ নড়াতে পারেনি । দিদিমনিদের দেবী ভাবের  ধাচা  থেকে বেশ ভালই  মুক্ত হতে পেরেছেন নতুন প্রজন্ম । বসে কেউ একটু ঝিমিয়ে নেন । সকালে ঘুম থেকে ওঠা অব্দি ঘোড় দৌড়  । রান্নার লোক থাকলেও বাচ্চার টিফিন , নিজের টিফিন ,  বরের টিফিন । এখন খাওয়া তখন খাওয়া  বন্দোবস্ত করা ।দিনের সব কিছুর ব্যবস্থাপনা  করে রেখে আসা । ফিরতে ফিরতে তো সেই সন্ধ্যে । সুতরাং একটু খানি চোখ বোজা । কেউ কেউ আবার বই খুলে বসেন । এই তো দিনে একটুখানি নিজের মত করে সময় পাওয়া । কখন দেড় , কখন দুই ঘণ্টার যাত্রা । কেউ কেউ আবার এই সময় টুকু নিজের খাতা খুলে বসেন । কোথায়  কবে কি করলেন । বর কবার বিদেশ গেলেন  ,ছেলে কত টাকা রোজগার করে , সে বছর ক টাকা বর ইনকামট্যাক্স দিয়েছে ।  তা নিয়ে আবার মজাও কম হত না । এই রকম লোকদের খচাতে জুড়ি ছিলনা সুমির ।  'তারপর কি হল বলুন না  সীমাদি । ছেলের জন্য পাত্রি পেলেন , কোটিপতি ,ইঞ্জিনিয়ার ?' তিনি অতি উৎসাহে বলতে লাগলেন বর এবং ছেলের খতিয়ান । আর তারপর পিটপিট করে হাসতে লাগলো  আশপাশ।
তা সে দিদিমনিদের ওপর আবার অনেকে মহা খচা । 'এই এসেছেন ~ এখনি শুরু হবে কোথায় নামবেন , কোথায় নামবেন ।' দোষ নেই এতক্ষনের যাত্রা বসতে তো হবেই ।  কোন কোন যাত্রি সহৃদয় । উদ্যোগী হয়ে  বল্লেন কোথায় নামবেন । কেঊ কেঊ  কিছু বললেন না । কিন্তু টুক করে পরের স্টেশনে নেমে গেলেন ।   সিটটি হয়ত পাওয়া গেল না ।
সাড়ে দশটার ট্রেনে থাকে সবজি মাসিরা । ভোর চারটের উঠে বেরোতে হয় । তারপর শেয়ালদায় সবজি বিক্রি ।সব সময় কিছু বলার জন্য  ব্যস্ত ।  হয়ত সারা দিনের ক্লান্তি ।  তবে প্রায় ই সবার সঙ্গে উচ্চকিত । দিদিমনিরা জায়গা পাননি দাঁড়িয়ে আছেন । চুল উড়ে যদি কোন কারনে গায়ে লাগে তাহলে খুব রাগ হয় মাসিদের । এ নিয়ে বেশি কথা বলতে গেলে বলে বসল হয়ত' জানি জানি ব্যাগ দুলিয়ে কোথায় যাও ! 'সব্বনাশ ! তারপর আর মুখ খোলে কেউ ? ভদ্রলোকের  নিকুচি করেছে । পুরো আকুপাংচার ভদ্রতার মানদণ্ড। জেনারেল কামরায় থাকলে  দেখা যাবে  সঙ্গে  একটি  প্রেমিকপ্রবর  বর নয়, আশনাই -এর রকম সকম দেখলেই  বোঝা যায় ।  চোখে মুখে লজ্জা । এরপর উঠবে  সকালের খাবার । সেই কোন রাতে  উঠে কোনোমতে দৌড়ে বেরিয়ে আসা । কারো  কারোকে  আবার এর মধ্যে রান্না বান্না করে রেখে আসতে হয় । মুখে চা ছাড়া কোন কিছু দিয়ে আসা হয় না । তাই খাওয়া । পরোটা ,আলুর দম , ডিমের ঝোল কখনো কখনো । সঙ্গে জল ও নিয়ে আসে ভেন্ডার ছেলেটি । শেষে মিষ্টি । খুব যত্ন করে খাওয়ায় ছেলেটি । সবাই মিলে হই হই  ,যেন যৌথ পরিবার খেতে বসেছে । এটাই হয়ত সারাদিনের পুষ্টিকর খাওয়া ! তারপর সারা পরিবার কে খাইয়ে কি আর জোটে । বাড়ি পৌঁছেই তো ঘোড় দৌড় শুরু হবে । ফুলওয়ালি  ও ব্লাউস মাসিদের  আবার কাজে ও বসতে হয় বাড়ি গিয়ে ।  দশটি  টি  ব্লাউসে বোতাম লাগালে এক টাকা । দশটি মালা গাথলে এক টাকা । তখন বাড়ির কন্যা সন্তানটিকে রান্নার হাল ধরতে হয় । তাই কখন কখন  ট্রেনে বসেই হাত চলতে থাকে ।বিকেলের ট্রেনে থাকে শেয়ালদার দিদিরা । দাঁড়াতে হবে স্টেশনের বাইরে খদ্দের ধরার জন্যে । ভেতরে গেলে পুলিশের ঝামেলা । তাদের মুখে সব সময় একটি সংকুচিত ভাব । সিঁথিতে এক ঢাল সিদুর । নিপুন শাঁখা পলা । মলিন একটি  ব্যাগ । কথা খুব কম বলে । ঝামেলা হলে অন্যকথা । তখন রণরঙ্গিণী ।  আর আছেন সুনিপুন নারী সাজে  মানুষ । দঙ্গল বেধে ওঠেন । চুন থেকে পান খসার দরকার নেই ,এমনিতেইরাখে হরি মারে কে । ভয়ে কাঁটা । বসার জায়গা দিয়ে নিশ্চিন্ত ।

অপূর্ব মানুষের অবিরাম চলা । মনে হয় সমস্ত সমাজটা যেন এক কামরায় ঢুকে গেছে ।  শ্রেণিহীন রেলের কামরা । ছোট্ট একটি বাংলা । ভারতবর্ষ ছোট হয়ে জায়গা খুঁজে নিয়েছে ।
                                                ~~~~