সে , ওরা , আমি
মূল অসমীয়া গল্প ঃ প্রার্থনা শইকীয়া
বাংলা রূপান্তর ঃ নন্দিতা ভট্টাচার্য
বাংলা রূপান্তর ঃ নন্দিতা ভট্টাচার্য
এক অদ্ভুত অস্থিরতা ওকে গিলে
খাচ্ছে । বেরোতে চাইলেও বেরোতে পারছে না ।আবার এর ভেতরে ঢুকে থাকলেও মজা পুকুরের মত ওকে নিঃশেষ করে দেবে। এই এক অদ্ভূত টানাপোড়েনের
মধ্যে থাকতে থাকতে সে মাঝে মধ্যে ভীষন ক্লান্ত হয়ে যায়। সজোরে প্রতিপন্ন করতে
চায় নিজেকে , নিজের স্থিতিকে । এরকম সময়ে সে সমমনস্ক বন্ধুবান্ধবদের
দলে ভিড়ে
যায় নাহলে অস্থিরভাবে কবিতা লেখে
। আর অন্য সময়গুলোতে এই টানাহেঁচড়ার
চাপানউতরে সে একটি অদ্ভূত খেলায় ঢুকে পড়ে ।
ক্রিকেট ভদ্র লোকের খেলা। তথাকথিত ভদ্রলোকের
তালিকায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত না করলেও ,
ক্রিকেট ওর প্রিয় খেলা। ছোটবেলা , ওর গ্রামের অন্তরঙ্গ বন্ধুমহলে এক পাকা ক্রিকেট
খেলোয়াড় হিসেবে ওর বেশ খ্যাতি ছিল। বাঁশের ফলা
নিয়ে মাটিতে পুতে স্ট্যাম্প বানিয়ে ওরা মহা আনন্দে খেলে যেত। প্রাথমিক
বৃত্তি পরীক্ষায় বসার শর্ত হিসেবে চাওয়া ক্রিকেট ব্যাটটি মা ওকে পরীক্ষার পর দিনই এনে দিয়েছিল। আর সে
দিন থেকেই সে হয়ে গেল ওদের ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক। ......... এগুলো পুরানো কথা ।
ওর অতীতের বর্ণময় স্ন্যাপ’শট । এখন এগুলো কথা মনে
হলে নিজেরই কেমন হাসি পায়। মদের
আড্ডায় হঠাৎ করেই সে অতীতের কথা বলার চেষ্টা করলেই ওরা চেচামেচি শুরু করে ।
‘বাদ দে, বাদ দে , মলুয়া (বন্ধুরা
আমাকে মলুয়া বাঁদর বলে ডাকে) তোর অতীত
রোমন্থনটা এবার দয়া করে বন্ধ কর ।‘
ও
চুপ করে যায় । তিন আঙ্গুল মাপের পেগের তলায় সে ঝাঁপ দেয়। ও এখন ওর পুরনো
স্মৃতি নিয়ে পুরনো ক্রিকেটের মাঠে । নেশা বেশি হলে কখন বাঁ হাত টা ওপরে তুলে চিৎকার করে – ‘দে’টস আউট ‘ বলে
।
আবেগিক মুহূর্ত গুলোতে সে নিজেকে
একটি পরাজিত ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক বলে ভাবে। নিজের ভেতরে পাক খাওয়া পরাজয়ের প্রতিটি মুহূর্ত । রি’ক্যপের সময় সে নিজের ভুল নিজেই নির্ধারণ করে । আবেগের মুহূর্ত বেশি হল অবশ্য নিজের ভুলকে শূন্য বা শূন্যের সমতুল্য বলে ধরে ও
প্রতিপক্ষের দোষ খুঁজে খুজে ‘গোবর’ বলে গালাগাল করে। আম্পায়ারের দোষে খেলার মাঠে অনধিকার প্রবেশ
করা গোল কিপার , প্রতিপক্ষের সস্তা
আক্রমণাত্মক নীতির শত ছিদ্রের মধ্যে থেকেও
ওর টিমের সবচেয়ে দক্ষ অথচ সর্বহারা ব্যাটসম্যান ও স্ট্যাম্প বদলানো হেলমেট
না থাকা ওর কৃষক বন্ধুর মাথা লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা প্রতিপক্ষের বলের মত --সবাইকে সে ‘গোবর’ গাল দিয়ে নিজের আবেগের
সাগরে ডুবে থাকে । ওর এমন আবেগের মুহূর্তের
স্থায়ীত্বকাল সল্প । কিন্তু সজোরে ওর
হৃদয়ের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে । কখনবা ঝমঝম
বৃষ্টিতে , কখনবা ঠা ঠা রোদ্দুরে কখনবা বোমা
বিস্ফোরণে মৃত একশ একষট্টি জনের স্মৃতিতে ; টেবিলের সামনের দেয়ালে চে’র
ছবিখানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কখন যে সে আবেগিক হয়ে উঠবে তার কোন নিদৃষ্ট সময় ,কারন-অকারন,সকাল-দুপুর,
তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই । আবেগের নেশার ওপরে ঢেলে দেয় কোয়ার্টার বা হাফ বোতল ম্যানসন হাউস ,নাহলে নাম্বার ওয়ানের এক একটি লার্জ
পেগ । আর পয়সা থাকলে রিচার্জ কার্ড কিনে ফোন করতে থাকে , সেই মুহূর্তে ওর যাকে যাকে মনে আসে তাকে তাকে ফোন
করে । ওর বন্ধুদেরকে –‘নমস্কার, দুঃখের ছায়ায় যদি একটুক্ষন না জিরোও তাহলে সুখের
পাখী কোথায় এসে বসবে!......কি খবর বন্ধু...আমি তো বিস্মৃতি গর্ভে লীন হয়ে যাওয়া এক
মাতাল প্রেমিক। ...জিজ্ঞেশ তো করতে পার কেমন আছি আমি !’
কখনবা সে বসন্তের মত চির সবুজ হয়ে থাকে । কখনবা শো শো শব্দে বাতাসে
ভেসে বেড়াতে চায় । শহরের একটি ব্যস্ত অঞ্চল
থেকে অন্য একটি ব্যস্ত অঞ্চলে রিক্সা করে ঘুরে বেড়ায় । গোল্ড ফ্লেক বা
নেভিকাট ঠোটে নিয়ে আবার রিকশওালা কেও যাচে নেবার জন্য । তিনআলি বা চারআলির রাস্তার
কোনের দোকানে বসে লিকার চা খায় , আবার রিকশাওয়ালা কেও খাওয়ায় । মার কাছ থেকে দরকার
হলে বেশি পয়সা চেয়ে সে এভাবে গোটা বিকেলটা কাটায় আর রাতে বন্ধুর সঙ্গে মদের আড্ডায়
ওর প্রিয় কবিতা আওড়ায় ---
‘...... আমার ভাবী স্ত্রীর শরীর
ঢাকার দাম আমার খোরাকি খরচের সমান
ভাবা যায় আমাদের বেচে থাকা ...।
তবু আমি ভালবাসি উলঙ্গ শিশুটির
হাঁসি, পুরানো
পৃথিবী নতুন হয়ে ওঠে আমার ক্ষুধার্ত
চোখের সামনে
সুন্দরী রমণীর হাড়ের কাঠামো সময়ের
ভেতর
দিয়ে চিতার দিকে চলে যায় আমি দর্শনের
মোটা বই বিক্রি করে কিনি রুটি ও মদ
শুধু বেচে থাকার জন্য এমনকি কখনো
লিখে ফেলি
বিশ্বাস করুন লিখে ফেলি অনাবশ্যক
কবিতা......’
জীবনটা ওর জন্য
হয়ে ওঠে অনন্য । নিজের খেয়াল-খুশি
,ইচ্ছে-অনিচ্ছের পথ ধরেই পার হয়ে যায় সোনালি জীবনের প্রতিটি পল, প্রতিটি অনুপল। বেহিসাবি জীবনের ‘বিন্দাস’ ঠিকানায় ও গড়ে তোলে ‘বেপরোয়া ‘ একটি জীবন ।
পাঠ্যক্রমের বই বিক্রি করে পাওয়া পয়সায় ও কেনে হুমায়ুন আহমেদের বই বা বুকে
পুঞ্জিভুত জমে থাকা হাজার তাড়নায় যখন কোন
আড্ডায় যোগ দেয়, তখন ওর হঠাৎ মনে
হয় ---‘সামর্থ্য থাকলে কি না করতে পারত এই হতভাগা মানুষগুলো । একটু ক্ষমতার
দরকার,একটু সামর্থ্যর প্রয়োজন ।‘
২
‘রিকশাওয়ালাকে সমর দশ টাকা দেবে না বলল। তর্কাতর্কি
লেগে গেল ।সমর রিকশাওয়ালাকে মারধোর করল । কাছের গুমটি দোকানে বসে ও দেখছিল বোধহয়। রিকশাওয়ালাকে
মারার সময়েই ও সমরকে ধরে আচ্ছা করে পিটুনি দিল। সঙ্গে ধন ও সামসুলরাও ছিল। পুলিশ সবগুলোকে ধরে
নিয়ে গেছে। ‘ –আসিফ ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল । মানুষটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে । ‘’এই ছেলেটার
জন্য আমার এক দণ্ড শান্তি পাবার উপায় নেই ।‘ –বলে ভেতরে গেল বাবাকে খবরটা দেয়ার
জন্য। প্রথমে ‘যাবনা’ বললেও সন্ধ্যের
দিকে বাবা থানায় গেলেন। লক আপের মধ্যে ও, ধন, সামসুল আর একটা লক আপে আগের থেকে
রাখা কিছু অচেনা বন্ধুদের মধ্যে ততক্ষনে ভাব বিনিময় শুরু হয়ে গেছে ।
‘রিকশাওয়ালাটাকে পয়সা কম দিল বলে
মানুষটাকে মেরে কি তুই সাম্যবাদ আনতে চাইছিস ।এই তোদের মত কিছু অকর্মণ্যর জন্যই এই আদর্শে ঘুন ধরেছে।কথাগুলো মনে রাখিস
।‘---ওর বাবা ওকে এ কথা কটাই বললেন।
কোথায় যে ভুল হল তিনি আর ভেবে পান না। তার যতটুকু দিতে
পারার সবটুকুই তো তিনি দিয়েছেন । তাকে সম্পূর্ণ ভাবেই গড়তে চেয়েছেন । কিন্তু সেই ছোটবেলা
থেকে, ক্রিকেট খেলবে বলে স্কুল পালানো ছেলেটিকে আজ পর্যন্ত তিনি ছুঁতে পরলেন না । ওর প্রত্যেকটি আব্দারের সংগে সঙ্গ দিতে দিতে তিনি
ক্লান্ত। তেতো-কষার এক অপরূপ সংমিশ্রণে তার সংসার চলছে । স্কুলে চাকরি করেন
।স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বা তার নিজের ছোট ছেলেকে আজকাল তার ভাল-মন্দের ধারনা গুলো দিতে সঙ্কোচবোধ করেন। হয়তবা বড় ছেলের মত
এক অদ্ভুত যুক্তিতে ওনাকে খারিজ করে দেবে । ছোটবেলা যখন ও নিজের বিচার-বিশ্লেষন
তুলে ধরে নিজের ভাবনা চিন্তাগুলো প্রকাশ করতো তখন ওর বাবা চমকে উঠতেন। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
ওর প্রত্যেকটা ভুলের সপক্ষেও যখন ও যুক্তি দেখাতে লাগল তখন বাবা আর ওর কথা
গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না। কিন্তু মা কি করে ওর কথাকে ,ওর ভুলগুলোকে ,ভুল
আবদারগুলোকে একেবারে উড়িয়ে দিল! ওর বাবা অবসর নেয়ার পর এক জনের আয়ে আর সংসার চলছিল
না । তবুও ওর কলেজের ফিজ বা বই কেনার পয়সা
জুগিয়ে গেছেন। ওদের মনে হত সে যা চায় তাই দিয়ে দিলেই হয়ত সে শুধরে যাবে । ...।এর
পরেও মারপিট করে থানায় যাওয়া কমে নি । অব্যাহতি
মেলেনি বাবার থানায় গিয়ে জামিনে ছাড়িয়ে আনা-ও । .....ওনার
অসহ্য লাগে । নিজের ওপরে রাগ হয় ।অনবরত রাগটা বিষাক্ত কীটের মত তার মগজে আক্রমন ঘটায় ।
.......‘আমার টাকা লাগবে। বই কিনব । ‘
কোন জড়তা না রেখে সে রান্না ঘরের
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল । আগেরদিন বাজার থেকে
আনা মিষ্টিকুমড়োর ডাটিগুলো কাটতে কাটতে মা জিজ্ঞেস করলেন---
‘কত?’
‘একহাজার’
মাথায় বাঁশপাতার পোকাটি কিলবিল করে উঠল ।
‘লজ্জা নেই তোর ‘ ঝগড়া করে জেলের
ভাত খেয়েও লজ্জা হয়নি তোর! বই কেনার টাকা
চাই তোর ! এই এক মাস হল তুই বই কেনার জন্য টাকা নিয়েছিস !মারামারি করতে করতে
গুন্ডা হয়েছিস তুই ! বই পড়ে আর পণ্ডিত হতে
হবে না তোকে !
‘ রিকশাওয়ালাটাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে
দিলে ভাল হত, না ? নিজের খিদের ভাত রেঁধেই কাত হয়ে যাচ্ছ , রিকশাওয়ালার শ্রমের
মুল্য তুমি কি বুঝবে ?
পা দিয়ে এক ধাক্কায় বালতি সরিয়ে
সে ঘর থকে বেরিয়ে গেল। ওর ভাল লাগা
মিষ্টিকুমড়োর ডাটিগুলো এক টান মেরে মা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিলেন ।
৩
‘ ......... দুঃখের সাগরে
নৌকো বেয়ে
যাব
ঝড়ে ক্লান্ত হয়ে
বৈঠা হারাব।
দিশা খুঁজব
স্রোতের
বিপরীতে নৌকো বাইব
বেঁচে থাকব বলে
বেঁচে আছি
বলেই
উচ্ছিষ্ট চাটিনি ......’
ভণ্ড ,বুর্জোয়া মানসিকতাকে
গালাগাল করতে ওর কোন ক্লান্তি আসে না । ছোটবেলা
বাবার মুখ থকে পাওয়া ‘কমরেড লাল সেলাম ‘-র
যে আদর্শ ওর হৃদয়ে গেঁথে আছে তাকে
আঘাত করা প্রত্যেকটা লোককে সে ঘৃণা করে! অন্তর থেকে । মায়ের প্রতিও ঠিক এ রকম একটি
অনুভূতি পুঞ্জীভূত হয় । ওর রাগ হয় মায়ের ওপর । কথায় কথায় ওকে ঠাট্টা করা
আদর্শবিহীন গৃহিণী জীবনে তার পুত্রের ধিক্কার । গৃহকর্ম আর স্কুলে যাওয়া আসা ছাড়া কি-ই বা কাজ আছে মায়ের । কথায় কথায় আমাকে হেয়
প্রতিপন্ন করার বাইরে একটিও ভাল কথা মা আজ পর্যন্ত বলেছে কি? ...।।অসহ্য লাগে ওর । অসহ্যকর একটি মাথাব্যথা ওর মগজকে কুরে
কুরে খাচ্ছে । বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে সে সামসুলের খোজ করে । ধনর পকেটের পয়সায় একটা ফুল ও একটা হাফ বোতল কিনে ওরা অঙ্কুরের ভাড়াবাড়িতে গিয়ে
ঢোকে । পুর রাতটাই ওরা মদ ও সিগারেটের ধোয়ার আবেশে নিঁখোজ হয় । অন্য একটি পৃথিবীর সন্ধানে ও মদ গিলতে থাকে । আবার আবেগে ভাসতে থাকে। অসংলগ্ন ভাষায় আবার আম্পায়ারকে গালাগাল করতে
থাকে----
--‘শালা, শুয়োরের বাচ্চা ! আম্পায়ারগিরি
দেখাচ্ছিস ,হ্যাঁ ! তোর নির্দেশে সমস্ত পুঁজিবাদী শাসক ঢুকেছে । আমার প্রতিপক্ষ
,শালা। ওদেরকে ইশারা করে আমার সর্বহারা খেলোয়াড়দের শুষে খাচ্ছিস ---ভাগ, শালা
শুয়োরের বাচ্চা ,ভাগ,.........তোদের সব আউট ,সব আউট.........’
মদের নেশায় যতক্ষন সে আউট না হয়
ততক্ষন বকতে ই থাকে। মায়ের মুখটা মনে এলে ও সিগারেটের ধোয়ার ধুম্রজাল তৈরি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে
। ...... আর বাবার কথা মনে পড়লেই ও খুব অস্থির হয়ে ওঠে । শৈশবের ক্রিকেট গ্রাউন্ডের
মত অন্য একটি গ্রাউন্ডে সে বাবার হাত ধরে এগিয়ে যায় । পার্টির ‘হো’লটাইমার ‘ জাগাদিশ কাকা ও বাবার সঙ্গে সে বাবার তর্জনী আঁকড়ে ধরে হাটতে থাকে । কাশবনের মাঝখান দিয়ে ওরা চরের মধ্যিখানে বাস করা কয়েক ঘর মানুষেরর দিকে এগোয় । মানুষগুলোর সংগে
বাবারা কথা বলতে থাকে ।কথা গুলো বুঝতে না পারলেও মন দিয়ে শুনছিল ও ।ইতিমধ্যে সন্ধ্যে নামল ।বাড়ী ফিরে মিষ্টি
কুমড়ো ভাজা খেয়ে কোন একটি ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়ল ওরা । ......... সকালবেলা ধন যখন ওকে
জোরে জোরে ডেকে ঘুম ভাঙ্গাল , সে ধড়মড় উঠে দেখল সেই একই পৃথিবী রয়েছে ,একই মানুষ, একই
ক্রিকেট খেলা , একই ম্যাচ ফিক্সিং , একই পুঁজিবাদের অনধিকার প্রবেশ , ......একই ,
সব কিছুই এক......। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল । ধনর কাছ থেকে একশ টাকা নিয়ে সিটিবাসে ওঠে । কলেজের সামনের
‘দাদার দোকান’ থেকে একটা ফ্লেক ধরিয়ে উদাস দৃষ্টিতে কলেজের দিকে তাকিয়ে থাকে ব্যস্ত হয়ে হেটে যাওয়া মানুষগুলোর দিকে । ...... হঠাৎই
ও সিদ্ধান্ত নেয় -----‘ কিছু একটা করতে হবে ; অন্তত পক্ষে রিকশাওয়ালা ঠেলাওয়ালা
জনগণকে সন্ধ্যেবেলা লেখা পড়া শেখাবে .........কাজটা খুব শীগগির শুরু করতে হবে । ওর
ছাত্রসংগঠনের ছেলেদের ও আরও বন্ধুবান্ধবদের কথাগুলো বলতে হবে । ,
ঠিক
তখনই তাকে দেখল । ব্যস্ত পায়ে ইলিয়ট ,সেক্সপিয়ার ,ব্যগে ভরে দ্রুত হস্টেলে ফিরছে সে । ওর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ।
হঠাৎ ও চঞ্চল হয়ে ওঠে । তাড়াতাড়ি ফুটপাথ থেকে নেমে তার সঙ্গ ধরে ----
‘নমস্কার,
দুঃখের ছায়ায় একটু সময় না জিরোলে , কোথায় বসবে সুখের পাখী । কি খবর বন্ধু ?
আমি ত স্মৃতি বিচ্যুত এক মাতাল প্রেমিক । জিজ্ঞেস
ত করতে পার কেমন আছি আমি !’
৪
সে ওকে যতখানি জানে সেই নিরিখে যদি মাপতে যায় তাহলে ওর দশভাগের এক ভাগ জানতে পারবে
। তবুও সে যতটা জানে ততটাই যথেষ্ট বলে
ভাবে --- সে ওর সঙ্গে একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত । অর্থাৎ দুজনে একই মতাদর্শে
বিশ্বাসী । ও মাঝে মাঝে মদ খেয়ে মাতলামি করে , আবার কলেজ নির্বাচন গুলোতে যে
নিরন্তর ঝগড়াঝাঁটি চলে তাতেও সক্রিয় অংশ গ্রহন করে ; ও কবিতা লেখে , মাঝে মাঝে
বিভিন্ন পেপার-ম্যাগাজিনে সেগুলো প্রকাশিত
হয় ; ওর একটা বৃহৎ বন্ধুমহল আছে ,ওর বন্ধুবান্ধবদের মতামত ওদের সংগঠনের সঙ্গে
মেলে ইত্যাদি ইত্যাদি । ওর সম্পর্কে সে এই
খবরগুলো নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে । উপরন্তু কিছু খবর ওর রুমমেট ওকে যোগাড় করে দিয়েছে । সেদিন সংগঠনের
কাজ শেষ করতে একটু দেরি হয়েছিল --তারপর ও তাকে বেশ রাত করেই রিকশা করে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল । আর সেই দিন রাতেই, আমার রুমমেট
রাতে ভাত খেয়ে উঠেই, তাড়াতাড়ি তাকে বসিয়ে ওর সম্পর্কে জানা আরও খবর উগরে দিতে লাগল ----
‘ দেখ চাকি ! তোর মা বাবা এখানে তোকে পড়তে
পাঠিয়েছে , পড়াশুনো মন দিয়ে কর । ...... ও- যে কি খারাপ ছেলে তুই জানিস না । গত
বছর ওর সঙ্গের একটি ছেলেকে মজা করে ক্ষ্যাপানোতে সে ঐ ছেলেটিকে মেরে হসপিটাল
পাঠিয়ে দিয়েছিল ।পুলিশ ওকে খুঁজতে এসেছিল
। এগুলো কলেজের সবাই জানে ! তারপরেও ওর রেজাল্ট দেখেছিস তো ? সেকেন্ড সেম দেয়নি । ও যে
নিজেকে কি ভাবে !......তুই ওর থেকে অনেক
ভাল ছেলে পাবি, জানিস ?’
...... তবুও সে ওর কথা ভাবে !তার সঙ্গের মেয়েরা যখন তাকে সি ,সি, ডি ‘র রঙ্গিন আড্ডাতে
নিয়ে যায় , তখন তার ওর কথা খুব মনে হয় । কিন্তু কফির কাপে চুমুক
দিয়ে কিম্বা ওর রুমমেটের ছেলে বন্ধুদের
শপিং মলের বাইরে থেকে কিনে দেয়া
পপকর্নের প্যাকেট হাতে নিয়ে সে উপলব্ধি
করে ‘ আসলে ওর রুমমেটের কথামত ও একটি খারাপ ছেলে । তাকে সুখী করার মত , বা তার ইচ্ছে পুর্ন করার মত কোন
ক্ষমতা ওর নেই , ও খারাপ ছেলে । ওর নিজের কোন ভবিষ্যত নেই । তাহলে অন্যের
ভবিষ্যতের দায়িত্ব ও কি করে নেবে? ও মদ খেয়ে মারামারি করে । ...।।কবিতা লিখতে
পারে বা সাম্যবাদ নিয়ে বড় বড় বুলি ঝাড়তে পারে , কিন্তু
ও তোকে ধোকা দিচ্ছে মাত্র । ওর সঙ্গে
গিয়ে কি সে একটা উশৃঙ্খল জীবন যাত্রা বেছে নিতে চাইছে ? ‘...... অনিচ্ছাসত্বেও
বাজতে থাকা মোবাইলটা সে হাতে তুলে
নেয়---
‘হেল্ল ‘।
‘ কি খবর ...... আজ অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম। একটা খুব জরুরি কথা তোমায়
বলার ছিল । আমার তোমাকে ভাল লা......’ ‘অহ’!(সে ওকে বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে দিল না ) বাড়ি
থেকে ফোন করছে । ‘ওয়েটিং –এ আছে কলটি । আপনি প্লিজ পরে চেষ্টা করুন । ‘
একটু পর ও আবার ডায়েল করল ওর
প্রিয় নম্বর ৯৯৫৪১......
তাকে অতিষ্ঠ কর তুলল অসহ্যকর সেই কণ্ঠস্বর ---‘দি এয়ারটেল কাস্টমার
ইউ আর ট্রায়িং টু কল ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ । প্লিজ কল আফটার সাম টাইম ।‘
৫
অতিষ্ঠ হয়ে ও হাত থেকে মোবাইল ফোনটা মাটিতে
আছড়ে ফেললো । বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা ভেব
ও চুপ করে বসে রইল । অঙ্কুরের ভাড়া বাড়িতে বসে ও মদ খাওয়ার কথা ভাবে । প্রচণ্ড
একটি অভিমান ওর বুকে জমা হয়েছে, জেগে উঠছে এক গভীর বিষাদ-সিন্ধু ওর মনে । সে জীবনকে নিয়ে
মগ্ন হল ,জীবনকে মেপে দেখতে চাইল ---- দৈর্ঘ ও প্রস্থে , প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিতে । কিন্তু ও যে
ভুলে যায় পাটীগণিতের হিসেব ;যাপন করে
এক বেহিসেবি ,বেপরোয়া জীবন এবং আবারও
ব্যর্থ হয় । ও ভাবা সত্যি কথাগুলো বার বার কেন মিথ্যে হয়ে যায় ---সাম্যবাদ থেকে
শুরু করে ওর জীবনের ছোট ছোট ঘটনা গুলোতে অবাঞ্ছিত প্রতারকের দল অনধিকার
প্রবেশ করে ওকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে । সুরক্ষিত ভবিষ্যতের পূর্ব শর্ত
পালন করতে পারিনি বলে আমি এক ব্যর্থ প্রেমিক। ও আবার উদ্বেলিত ,ভাসমান ।
সদ্যসামাপ্ত ক্রিকেট খেলার পরাজিত দলের অধিনায়ক হিসেবে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কথা ভাবে ---- ‘ আসলে আবহাওয়া আমার
অনুকুলে ছিল না । টসে হেরে প্রথম ব্যাটিং করার জন্যেই এমন হল । প্রতিপক্ষকে সঠিক
উত্তর দেবার সপক্ষে আমাদের সর্বহারা দলটির কাছে আসলে কিছু ছিল না ---- জীবন সুরক্ষার জন্য বিজ্ঞান সম্মত
ভাবে তৈরি হেলমেট , রান নেওয়ার জন্য দৌড়ানোর সামর্থ্য ,একজন শক্তিশালী খেলোয়াড় হওয়ার জন্য পুষ্টিকর আহার
...... আমাদের এগুলোর কোনটাই ছিল না । ...... অথচ সব আছে ভেবে বোকার মত আমরা
ময়দানে নেমে পড়েছিলাম ।‘
এক অসহ্য রকমের মাথা ব্যথায় ও
কুঁকড়ে যায় , ওর ঘিলুটা যেন কে নিংড়ে নিচ্ছে । তিন পেগ শেষ
করার পরেই ও আম্পায়ারকে গালাগাল দিতে শুরু করে ---- ‘ শালা প্রেমের বাজারেও নিলাম
হয় আমার অনুভুতি । ধূর্ত আম্পিয়ার ! প্রেমের বাজারেও তুই ব্র্যাণ্ডেড বর সাজিয়ে
সাজিয়ে পাঠাচ্ছিস । সব তোর পুঁজিবাদী চাল
, সব তোর ইশারায় চলছে !...শা...লা আম্পয়ারগিরি দেখাতে এসেছিস হাঃ , তোর ঈশারাতেই অনুপ্রবেশ ঘটেছে পুঁজিবাদের
...... শালা সব ব্রান্ডেড ------ব্যাট , বল , জুতো , বর ...... শা...লা তদের
অঙ্গুলির নির্দেশে আমরা সর্বহারায় পরিনত হয়েছি ---- ভাত, ঘর, ইজ্জত, প্রেম সব তোরা
শুষে নিচ্ছিস ......শ।।লা ... কুকুর ,ভাগ ,ভা – গ , শা ... লা... এখান থেকে ।‘
পরেরদিন আবার সামসুলের কাছ থেকে
একশ টাকা ধার করে। রিক্সা করে উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে একটি ব্যস্ত অঞ্চল থেকে অন্য
একটি ব্যস্ত অঞ্চলে ও ঘুরে বেড়াতে লাগল । মাঝে
মাঝে একটু লিকার চা ,একটা বিড়ি বা সিগারেট । রিকশাওয়ালাকেও খাওয়ায় । অনেক কাজ করার কথা ভাবে
সে ! ...আবার ভেসে যায় আবেগে ...। বসন্তের মত সবুজ হতে চায়—সুবাতাস হয়ে ভেসে থাকতে
চায় একটি সুন্দর সুরের মত......
পরিশিষ্ট
জসমি, পম্পি , চাকির অযৌক্তিক প্রত্যাখ্যানের পর সে অনেকবার মদ ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছিল । সিগারেট
ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছিল। এক সপ্তাহ পর পর চান করা ছেড়ে প্রতিদিন চান করার কথা
ভেবেছিল । ... কিন্তু এত সহজে কি সব বদলে ফেলা যায় !সেটা সামাজিক পরিবর্তনই হোক বা ওর মনের গতিরই হোক !ওকে আমি
সঠিক অর্থে বুঝতে পেরেছি বলে দাবি করছি না
। কিন্তু বন্ধু হিসেবে সে যখন আমাদের তার অসন্তুস্টি ও অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস ঝরায়
, তখন বার বার ই আমদের আলোচনা হয় ওকে
নিয়ে।
১ম বন্ধু--- ও আসলে
বড় আবেগে ভাসে । কিন্তু আজকালকার মেয়েরা তো এত আবেগ নিয়ে চলে না , ওরা প্র্যাক্টিকাল
ছেলে খোঁজে । প্রেমিক হলেও ওকে প্রাক্টিকাল হতে হবে, সিসিডি , বারিস্থা ,
মাল্টিপ্লেক্সে নিয়ে যেতে হবে । আর যাই বলিস না কেন সাম্যবাদী প্রেমিকাও শালা একই ......আদর্শকেও
ওরা ট্রেডমার্ক হিসেবে ইউজ করে ।
২য় বন্ধু---এই বাদ দে ওর প্রেমটেম। ও আসলে সবসময়
মধ্যমনি হয়ে থাকতে ভালবাসে আর এই জন্য এতরকমের বাহানা বার করে ।
৩য় বন্ধু--- কিন্তু মার কাছ থকে ফাঁকি দিয়ে পয়সা
নেয়াটা কেমন কথা ।মা-বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে মারা !
৪র্থ বন্ধু--- বাদ দে তো! ও এক
স্বপ্নের জগতে বাস করে । আদর্শের ক্ষেত্রে বা প্রেমের ক্ষেত্রে ও ভীষণ ডিভো’টেড !...... ও নিজের মত করে বাঁচতে চায় , এই
ধর—স্নেহ-ভালোবাসা , সাম্যবাদী সমাজ , প্রতিবাদের ভাষায় লেখা কবিতা , এগুলোই ওর
বাঁচার রসদ ।
... আমি সব সময় চুপচাপ থাকি ওকে
বোঝাবার চেষ্টা করি । কখন কখন এ রকম আলচনায় অংশ নেই ।বিশেষত যখন তিনটে লার্জ পেগ খাওয়ার পর ওর কথা ওঠে। খুব সাবধানে মন্তব্য করি । ---
আমি ঃ এক অদ্ভুত অস্থিরতা ওকে গিলে খাচ্ছে । বেরোতে চাইলেও বেরোতে
পারছে না । এই অস্থিরতা ওকে গ্রাস করে, তলানিতে এনে দাড় করায় ।
আর এই অস্থিরতার টানাপড়েনে ও ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে নিয়ত......... ।
§ গল্পটিতে উদ্ধৃত প্রথম কবিতাটির অংশ ‘হাংরি
জেনারেশনে’র বিখ্যাত বাংলা কবি ফাল্গুনি
রায়ের কবিতা থেকে নেয়া ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~