মরিয়ম
মূল অসমীয়া ঃ জয়ন্ত শইকিয়া
বাংলা অনুবাদ ঃ নন্দিতা ভট্টাচার্য
কালু নদির পাকা সেতুটির ওপর দিয়ে যেতে যেতে মরিয়ম বিবির একটু চুপ করে দাঁড়াতে মন চাইল। সেতুর কয়েক ফার্লং দূরে ঐ কাঁটাতার লাগোয়া বি এস এফের ক্যাম্প । তার ওপারে বাংলাদেশের জালুয়াঘাটের মাথার ওপরে ডুববো ডুববো করেও ডুবতে না চাওয়া সূর্য মাছের ঝুড়ির মত ঝুলে আছে । ওপারের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ও ভাবে রহমত মিঞা কি এখনও ওই কোনায় একটি ছোট ঝুড়িতে ক-খানা হাঁস-মুরগির ডিম নিয়ে বসে ? মরিয়ম বিবি জানে টাকায় সাতটা ডিমের জন্যে কেউ মানকাচর থেকে হেঁটে রংপুর আসবে না । তার জন্যে আবশ্য মরিয়ম বিবির কোন আক্ষেপ নেই । আক্ষেপ শুধু উচ্ছল বোনটার জন্যে। বিয়ের পরের বছর দেখা হতে ই দিদি ওকে ক্ষেপাচ্ছিল,
কালু নদির পাকা সেতুটির ওপর দিয়ে যেতে যেতে মরিয়ম বিবির একটু চুপ করে দাঁড়াতে মন চাইল। সেতুর কয়েক ফার্লং দূরে ঐ কাঁটাতার লাগোয়া বি এস এফের ক্যাম্প । তার ওপারে বাংলাদেশের জালুয়াঘাটের মাথার ওপরে ডুববো ডুববো করেও ডুবতে না চাওয়া সূর্য মাছের ঝুড়ির মত ঝুলে আছে । ওপারের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ও ভাবে রহমত মিঞা কি এখনও ওই কোনায় একটি ছোট ঝুড়িতে ক-খানা হাঁস-মুরগির ডিম নিয়ে বসে ? মরিয়ম বিবি জানে টাকায় সাতটা ডিমের জন্যে কেউ মানকাচর থেকে হেঁটে রংপুর আসবে না । তার জন্যে আবশ্য মরিয়ম বিবির কোন আক্ষেপ নেই । আক্ষেপ শুধু উচ্ছল বোনটার জন্যে। বিয়ের পরের বছর দেখা হতে ই দিদি ওকে ক্ষেপাচ্ছিল,
‘দক্ষিন শালমারার মাছ খাইয়া বেটি সুন্দর হইয়া গেলাম।‘
মরিয়ম বিবির গলা একমুঠো পাটের আটি মত কে যেন চেপে ধরেছে । না ,আর দঁড়াবার সময় নেই,বেলা
অনেক হল। মিরজুমলার মাজার শরিফ থেকে আজান শোনা যাচ্ছে। বাসে ফুলবাড়ি পৌছাতে
তিনঘণ্টা, তারপর নাগের বাঁধ দিয়ে গিয়ে তিনটে ছোট নদি পেরিয়ে ঘর পৌছান। আজ
অনেকদিন পর মার কাছে এসেছিল । মার পাসপোর্টের কাজ এখনও শেষ হয়নি । দিদির
জানাজা হওয়ার এই ন দিন। ফেনসিংর এপারের উঠোন থেকে মরিয়ম ও ওর মা অনেকক্ষন কাঁটাতারের ওপারের দিদির
গ্রামটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল । নাতিপুতিগুলোর জন্য বুড়ির বুকটা হা হা করে উঠল
। ফেনসিংয়ের ওপারে একটি লোক সাইকেল নিয়ে কোথায় যাচ্ছিল ।রহমত মিঞা নাকি ওটা ? না জামাইবাবু নুরুদ্দিন? মরিয়ম মাকে, মা মরিয়মকে জিজ্ঞেস
করব করব ভেবেও করতে পারল না । মরিয়ম দেখল
ফেনসিংয়ের ওপারে ওদের পুরান ভিটার চিহ্ন হিসেবে কেন্দুঝোপ ও খেজুরের ঝোপটি এখনও
রয়েছে । তার তলাতেই বি এস এফের ঘরের চাল । ওরা ওখান থেকে দিদির বিয়ের আট-ন বছর পর উঠে এসেছিল । দিদির বিয়ে হয়েছিল গায়ের ই নুরুদ্দিনের
সঙ্গে । গ্রাম মানে সাতচল্লিশের পর একটা সাদা খুটির
এপারে একদেশ ওপারে আর এক। চাচাজান বৌমারির ওদিকে মাস্টারি
করত, বাবা ছিল মানকাচরের হাবিলদার, সত্তর পর্যন্ত তো কারোর খেয়ালই ছিল না ।
পুরোটাই হা হা খোলা, রংপুর-রতনপুর মানুষ হেটে বাজার ইত্যাদি করত । যাবে না নাকি? বৌমারি
বাজারে তো এই সেদিন ও টাকায় সাতটা হাঁস-মুরগির ডিম পাওয়া যেত,এক টিন রেডকাউ দুধ
খুব বেশি হলে দশ টাকা ।
যেদিন কাঁটাতারের ফেন্সিং পোতা হল ,মরিয়মদের নিয়ে দশটি
বাড়ির উঠোনের মাঝখান দিয়ে বুকচিরে চলে গেল সোজা নাক বরাবর। সরকার
এদিকে মাটি দিয়ে ওদের উঠিয়ে আনল । দিদি জামাইবাবুর ঘর–মাটি ওপারে চলে গেল। সেই
দিদির মৃত্যু সংবাদ শুনে মরিয়ম ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছে দক্ষিন শালমারা থেকে ।
ইতিমধ্যে গ্রামীন ফোনে কথা হয়েছে জামাইবাবুর সঙ্গে ।
কাছেই থাকা গরু বেপারি আনোয়ার ওপার থেকে গ্রামীণ ফোনের একটি সিম এনে রেখেছিল। ওর
কাজই এরকম ! প্রত্যেকদিন আই এস ডি ? কম
টাকা হবে ? গ্রামীণ ফোন থেকে লোকাল কলও হয় । অনেক অনুনয় করে আনোয়ারের সেই ফোন
থেকেই মরিয়ম ওর জামাইবাবুর সঙ্গে কথা বলেছে।
হ্যাঁ, পাসপোর্টের কাজ হয়ে গেলেই দাদা মাকে একবার নিয়ে যাবে । কম টাকা লাগে
পাসপোর্ট অফিসে? টাকার কথা বললেই মরিয়মের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে । জামিদার
মানুষ ছিল দাদাজান । দাদাজানের দান করা মাটিতে মানকাচরের দুটি স্কুল ঘর হয়েছে। পরে
যখন ফেন্সিং দেয়া হল তখন সব মাটি ওপারে চলে গেল । কে ক্ষেত করতে যাবে ওখানে?
দাদাজান জামিদার
ছিল ,ভাইজান ফকির হল । পারলে মরিয়মের উচিত দু পয়সা দিয়ে ওদের সাহায্য করা । কিন্তু মরিয়ম দেবে কোত্থেকে ? স্বামীর মৃত্যুর
পর ও-ই জানে কি করে দু মুঠো ভাতের গুজরান করে । দক্ষিন শালমারার ওর ভিটে ,ক্ষেতের
জমি নদী সড়াৎ করে গিলে খেয়েছে। ভাগ্যিস শাশুড়ি ওকে ধাই বিদ্যে হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন
।
বাসের ঝাকুনিতে মরিয়মের কোমরটা ক্চ করে উঠল । বাসে গাদা
গাদা পাটের আটি তোলার মত মানুষ তুলছে কনডাকটার । কাছে বসা ছেলে দুটো গুন গুন করে
কথা বলছিল । দক্ষিন পারের ভাষা নয়, ভাটিয়াও নয় ,দেশি(গোয়ালপাড়ার) ও নয় । কি ভাষা ? মরিয়ম কান পাতে, হ্যাঁ –শুদ্ধ
কেতাবি অসমিয়া ভাষা । হয়ত গুয়াহাটীর
মানুষ ।
‘সবাই বাংলাদেশী হয়ে যাচ্ছে এখানে দেখছ ?A
বাংলাদেশি ?—মরিয়ম বাসের জানালা দিয়ে মাঠের ওপারের ফেনসিঙ্গের দিকে
তাকিয়ে থাকে । এ পার থেকে এক ঝাক বক ওপারে উড়ে গেল । ওপারের একটি মানুষ বিকেলের
ছায়া হয়ে দাড়িয়ে আছে। রহমত
মিঞা না কি? ও – কে?
বুক জলে ডুবে পাট তুলছে সুঠাম যুবক রহমত ! বেহেস্তের নুর যেন নেকদিল ইনসান
রহমত মিঞার দু চোখে থিতু হয়ে আছে।
ওর বিয়ে যে বছর হল তার আগে একবার জামাইবাবু, দিদি ও রহমত
মিঞার সঙ্গে নৌকো করে জলেশ্বর গিয়েছিল মরিয়ম বিবি। পাক পরবদিগারের খিদমদগার পীরবাবা
হজরত শাহ সৈয়দ নাসিরুদ্দিন আহমেদ কাদেরি বগদাদীর পবিত্র মাজার শরিফ জলেশ্বরে ।জলেস্বর দরবারে
রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখে ফাতেহা ই দোহাজ দামের উৎসব মোবারকের জন্য আসাম, বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ
থেকে লাখ লাখ অনুগামীরা এসে জড়ো হয় । সেই মেলাতেই রহমত মিঞাদের সাথে এসেছিল মরিয়ম
বিবি। সেই সময়ই রহমত মিঞা পিরবাবার মুরিদ ওর দাদাজানের মুখে শোনা পিরবাবার কামেলিয়ত, নুবুয়ত,
মারেফাত, হেদায়তের কথা ছাড়াও আরও অনেক
কাহিনি গড় গড় করে বলে গিয়েছিল মরিয়ম বিবিকে। নৌকোর মাথায় বসে
মাঘমাসের নাদিরপারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মন দিয়ে সেই গল্প
শুনছিল সদ্য যুবতি মরিয়ম ।
ছোটবেলাতেই অনাথ হওয়া মৌলানা ভাসানিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন
পিরবাবা । হ্যাঁ – 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্থানের' নেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ ভাসানী
পীবাবার মুরিদ ছিল। একবার ছোটবেলাতে মৌলানা ভাসানী কোন কিছু চুরি করে পিরবাবার
কাছে মিথ্যে কথা বলেছিল --'যে বেইমান এই কাজ করেছে ,জিন্দেগিতে তার আর কোন কাজ হবে
না।' তখন সর্বজ্ঞ পিরবাবা মন্তব্য করেছিলেন—'তাই হোক ,হামিদের কথা যেন ফলে ।'
হায়রে ভাসানি ,জিন্দেগিতে কোন স্বপ্নই সফল হয়নি ভাসানির। ধুবড়ির কত মুসলমান শুনল
'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্থান' । ভাসানি পালিয়ে গেলেন বাংলাদেশে । থেকে গেল শুধু একটা
চর---ভাসানির চর। ভাসানির, ধুবড়ির কোন স্বপ্নই পুরন হল না । কি নেক আলম ছিল
পিরবাবা? গোয়ালপাড়ার এম,এল, এ বলভদ্র দাসকেও পড়ার খরচ দিয়ে মানুষ করেছিলেন
পিরবাবা।
তাইতো ,পিরবাবার কাছে তো হিন্দু-মুসলমান সকলকেই আল্লাহ
রুহ ও জান দিয়েছেন । ওরা জানত সবচেয়ে
সুন্দর নামে ই আল্লাহ-কে ডাকা হয়। আল্লাহর
বাইরে ওরা যাকে যাকে স্মরন করে ,তাদেরকে তোমরা তিরস্কার কোরনা । কারন অজ্ঞতা বশত আল্লহ সুবাহনাহু ওয়া তাল্লাকে তিরস্কার করবে।'
কোরান মজিদের সুয়া আন আল মের ১০৮ নং আয়াত হয়ত ।এত কথা রহমত বিবির মনে থাকে না ।
কিন্তু মরিয়ম বিবির কখনও কখন সন্দেহ হয় । (হে পাক পরবদিগার,
তোমার রহমের সাক্ষীস্বরূপ পাঠানো পিরবাবার
হেদায়তকে সন্দেহ করে আমি অবিশ্বাসী নই ।')
কিন্তু মরিয়ম বিবির জন্য সত্যি এটা একটি কঠিন প্রশ্ন ।
ও কে ? ও কোথায় ?
ওর দাদাজানের যে বাড়িতে ওর বাবা জন্মেছিলেন , তখন ওদের
জমি-জমা সব ভারতে ছিল । যে ঘরটায় ওর জন্ম হয়েছিল ,সেটা ভারতের মাটি । ক্ষেত-খামার,--
একবার ওরা বলল ভারতে গেছে আর একবার বলল বাংলাদেশে গেছে । বড়টার সঙ্গে যা হয়েছে, হয়েছে ,
--বলে রহমত মিঞার সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে দক্ষিন শালমারার বুবুলের বাবার সঙ্গে বিয়ে
দিল , তখন 'কবুল হো , কবুল হো ' , বলে বুবুলের বাপের গাঁয়ে গিয়ে পৌছাল মরিয়ম। রহমত মিঞার কথা কখনও ফেনসিং এপারে পৌছাতে দেয় নি ।
অনেকটা জমি-জমা না থাকলেও , জমির পরিমান মোটামুটি কম ছিল
না বুবুলের বাপের । ধান, পাট , সর্ষে ফলত জমিতে । কিন্তু হলে কি হবে ? নদি তো সব
জমি খুবলে খেয়ে ফকির করেছে আমাদের । ক্লাস এইট পর্যন্ত অসমীয়া মাধ্যমে পড়েছে মরিয়ম
। প্রত্যেক বারই হাত চিহ্ন দেখে দেখে ভোট দিয়েছে সে । গ্রামের ধাই বলে হাতে থাকা
বিদ্যার জোরে ও বিধবা বলে কাজও জুটেছে ওর । দুটো ছেলে অসমীয়া মাধ্যমে পড়ে। আর কোন
মাধ্যমের স্কুল তো নেই এখানে ! এই পাশে বসা ছেলে দুটোর মত মানুষের কথায় ও কখন কখনও
ভাবে –মরিয়ম বিবি কি দুটো দেশের মাঝে ফেনসিংয়ের
মত ঝুলে আছে ?
কিন্তু ফেন সিং হয়ে কি শান্তি ফিরেছে ওই অঞ্চলে ? ওই
সেদিন তো বাংলাদেশের ডাকাতদল এখান কার একজন স্ত্রীলোককে গরুরগাড়ীতে তুলে নিয়ে
যাচ্ছিল ! ফজরের নামাজ পড়তে আসা বাংলাদেশের একদল লোক উদ্ধার করে ফেরত পাঠিয়েছে ।
মরিয়ম বিবি ভাবতে থাকে মানকাচরে ঠাকুরদার দানকরা জমিতে
আসমীয়া মাধ্যম স্কুলের কথা ।বাংলাদেশে মৃত দিদির কথা , ফেন্সিঙ্গের অপারে থাকা
রহমত মিঞার কথা , দিল্লি থেকে আশা মিরজুমলার কথা , বাগদাদ থেকে আসা পিরবাবার কথা
। তারপর
জোরহাটে রিক্সা চালান বড় ছেলে বুবুলের কথা । বাড়িতে অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকা
ছোট ছেলে ভুতুর কথা । ছোট ছেলের কথা মনে পড়তেই ও উদাস চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে
রইল । বাসটা লাফাতে লাফাতে শিঙ্গিমারী পার হল ।
বাড়ি পৌঁছেই মরিয়ম বিবি তাড়াতাড়ি করে উনুনে আঁচ দিল ।
ছেলেটার পেটে আগুনের খিদে । ও বেলায় পান্তা ভাত কটা খেয়ে শুয়েপড়েছিল । রাত এক
প্রহর হল , কটা লাকড়ি কেটে রাখবে সে হুঁশ ওর আছে ? তারপর কাচা লংকা দিয়ে ভাত কটা
মাখতে না মাখতেই দরজায় ধাক্কা !
'বুজান, অ বুজান।'
মরিয়ম বিবির বুকটা ধড়াস্ করে উঠল । গ্রামের দুটো ছেলের
সঙ্গে জোড়হাটে বুবুল রিক্সা চালাতে যাওয়া থেকে ওর মনে শান্তি নেই ।পাশের গ্রামের
দুটো ছেলে শিবসাগরে রিকশা চালাতে গিয়ে মার খেয়ে ফিরেছে দু সপ্তাহ হল। ওরা নাকি
বাংলাদেশী ! প্রানটি নিয়ে কোনমতে ছেলেগুলো বাড়ি ফিরেছে । কার আবার এই সময় বেরোবার দরকার হল ?
'এই সময় কেরা আইল রে ? '
' আমি মতিহারির ভাতার ।'
ইয়া আল্লা—আর আসার সময় পেল না । ভাতের থালা দেখে রেখে
মরিয়ম বিবি মিতিহারির ভাতারের পেছু পেছু এল ।
'ভুতু , দরজাটা বন্ধ কর ।'
না ভুতুর কোন সাড়াশব্দ নেই । হয়ত মায়ের ওপর রেগে আছে ।
সময় নেই ,অসময় নেই বাচ্চা বিয়োতে দে দৌড় ।
মরিয়ম বিবি ওদের বাড়ি পৌঁছে দেখল মতিহারী হাঁটু গেড়ে বসে চাপ দিচ্ছে । উনুনের পাশে
বসে ছেলেমেয়েগুলো চুলায় আগুন দিচ্ছে । ঘর বলতে-তো ইকরার বেড়ার এক কোঠা । ঘরের মাঝে
বিছানা পাতা ,রয়েছে একটি কলস ও চাঁচবার জন্যে বাঁশের টুকরো । মরিয়ম ছেলেমেয়েশুদ্ধু
মতিহারির ভাতারকে পাশের বাড়ি পাঠিয়ে দিল । পাশের বাড়ির আনোয়ারা হাতে পান সুপারি
নিয়ে মরিয়ম বিবির কাছে এসে বসল । শেষেরটা হওয়ার পর নিজে জেলায় নিয়ে গিয়ে মতিহারির
বন্ধ্যাকরন করিয়ে এনেছিল । সাড়ে চারশ টাকা মতিহারি আর আড়াইশ টাকা পেয়েছিল
মরিয়ম । তারপর আর কোথায় ছেলেমেয়ে না বিইয়ে
থাকবে ! সরকারি হাস্পাতালের অলিগলিতে ঢোকার উপায় তো আর নেই । এই তো এখন মতিহারি
হাটুঁমুড়ে মরিয়ম বিবির নাকের ওপর বসে ছেলে নামানোর জন্যে জোরে চাপ দিয়ে চলেছে ।
গরম জল বসিয়ে মরিয়ম মোতিহারির কাছ চেপে এল ।--জল ভাঙ্গছে । মেঝের বালি মাটিতে রক্ত-জলের ফোঁটাগুলো শুকিয়ে রয়েছে । হাঁপিয়ে
হাঁপিয়ে মতিহারি বলল সেই কখন থেকেই সে জোর
দিয়ে যাচ্ছে । মরিয়মের একটু
সন্দেহ হল । মতিহারি তো প্রথম পোয়াতি নয় – এত
যে ছট্ফট্ করছে ,ভীষণ যন্ত্রণায় চোখ উলটে দিচ্ছে ,এর মানেটা কি ?
'এই আনোয়ারা , যা সুবর্ণ বুজানরে ডাকার জন্য কাউরে জলদি
পাঠাইয়া দে ।' বাচ্চা উলটো হয়ে রয়েছে । এটা মরিয়মের হাতের কেস নয় । এখানে তো আর
ডাক্তার নার্স নেই । রাত–বিরেতে বাদ দে ,দুপুর বারটার আগে ঔষধ দেয়ার জন্য দারয়ানকেও
পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ । সরকারি
বিজ্ঞাপনগুলো তো দাঁত বের ,করে ঠ্যাং মেলে দাঁড়িয়ে থাকে
। কেকেরাকুছির অভিজ্ঞ ধাই সুবর্ণই ছেলে বিয়োন মায়েদের শেষ ভরসা ।
সরকারি কথার আগাগোড়াই কোন ভরসা পাই না ।
গতবার মেয়েলি গলার, রোগা–পটকা একজন স্যার কাদা মাড়িয়ে
এসে সরকারি সুযোগ-সুবিধার খা-খতিয়ান নিতে হাস্পাতাল এসেছিল। ম্যালেরিয়াতে মানুষ
মারা যাবার পর গুয়াহাটি থেকে আসা মানুষগুলোর সঙ্গে কোন যোগাযোগ থাকতে পারে ! গতবছর
একবার কি দুবার জেলার দুজন আধিকারিক দেখা
দিয়ে গেছেন । কিন্তু মরিয়ম বিবিদের কে জিজ্ঞেস করে ? সেই রোগা-পটকা এসে তাও যা হোক
খোঁজ খবর নিল একটু ।,'আপনাদের জন্য সরকার অনেক সুযোগ সুবিধে দিচ্ছে জানেন তো ? হাস্পাতালে ফ্রি তে ওষুদ-বিষুদ দিচ্ছে জানেন তো । উপরন্তু
মা-ও চৌদ্দশ টাকা পাচ্ছে । আপনিও
হাস্পাতালে ডেলিভারির জন্য নিয়ে গেলে টাকা পেতেন । মানুষ যায়না কেন ।
মরিয়ম বিবির হাসি পায় । মানুষগুলো
কি জানেনা ? কিন্তু ও বলে , জেবিবা বলে ,
সুবর্ণ বলে জেলার নার্স গলা চেপে ধরা সেলিমাও বলে । রোগা-পটকা চশমা মোছে আর লেখে ।
দক্ষিণ শালমারায় কোথায় আর মেটারনিটি ওয়ার্ড আছে ? জেলাতে
নৌকায় গেলে কমপক্ষেও সাতশ টাকা লাগে ।তারপর তো ডাক্তার ,নার্স , সুইপার ,সকলেই আছে
। সেলাইন ,পাইপ , ওষুদপাতি সব কিছুরই তো দরকার আছে । তারপর কাগজ বার করার জন্য
কেরানিকে টাকা দিতে হয় । বুধবারের দিদিমনিরাও তো খালি হাত ঘুরে এসে গায়ের লোকদের
ধমক-ধামক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে ।
'রোগা-পটকা' ভয় পায় । তবুও সে লেখে, সঙ্গেরটাকেও ফিস ফিস
করে কিছু বলে । তারপরও বলে যায় 'আপনারা কথাগুলো আর পালটাবেন না কিন্তু ?'
'রোগা-পটকা' আর ঘুরে আসেনি কিন্তু । দক্ষিন শালমারার
হাসপাতালের সামনে আরও দুটো বিজ্ঞাপন দাঁত বের করে
জিনের মত দাড়িয়ে রইল ।
আলো ফুটতে না ফুটতেই ফজরের নামাজের আগে আগেই মতিহারির
বরের সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে সুবর্ণ রওয়ানা হল । তাড়াহুড়ো করে পৌঁছে সুবর্ণরও একি
অবস্থা হল, ঠাণ্ডা মেরে গেল ও ।
'এই বুবুলের মা ওকে ঘরে রেখে দিয়েছ কেন ? জেলায় নিয়ে যেতে হবে মনে হচ্ছে !'
রাস্তার যা অবস্থা ,গোয়ালপাড়া বা ফুলবাড়ি নিতে হলে তিনটে
নৌকা বদলে গাড়ি ধরে যেতে যেতে বিইয়ে দেবে ছুড়ি । নৌকা নিয়ে সোজা ধুবড়ি যেতে হবে মনে হচ্ছে ।
মতিহারির স্বামী নৌকার খোঁজে গেল । সঙ্গে কারিমউদ্দিন
মাস্টার । ফিরে এল ওরা । নৌকা পাঁচশ টাকা চাইছে । আমার তো চারমাস মাইনে নেই । এই
হাসপাতালে বাচ্চা হলে চৌদ্দশ টাকা পাবি
,তার থেকেই নৌকর টাকা পরে দিয়ে দিবি ।
সকালের ব্রহ্মপুত্রর জল কেটে নৌকা এগোতে লাগল । বাংলাদেশের দিকে রিনিকি রিনিকি সবুজের
অবয়ব । মাঝে মাঝে নদির বালুচর ।
নায়ের ভেতরে সুবর্ণ ও মরিয়ম মতিহারির হাত পা ধরে আছে ।
মতিহারির কোন হুঁশ নেই । গলা থেকে হালাল করা গরুর মত গো গো শব্দ বেরোচ্ছে । নায়ের
ছৈ-এর দু দিক কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়া । মতিহারির ভাতার ও ফজলুল ছৈয়ের ওপর বসে
বিড়ি ফুকছে । একদল গরু নিয়ে যাচ্ছে মাঝি ।
গরুগুলো নড়াচড়া করছে না । ওদের শিং-এর ওপরে কাল মেঘ যেন সূর্যকে চেপে ধরেছে । ঝড়
আসবে নাকি ? মতিহারির স্বামির মনটা কেমন কু গাইছে । ওরা কি ধুবড়ি পৌছতে পারবে ?
মতিহারি বেঁচে ফিরে আসবে ত?
ফজলুল বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বিড়িটা ছুড়ে জলে ফেলে দিয়ে
বলল ,
'হাসপাতালটা এই বারেও হইলো না।নতুন মানুষ পাঠাবা বা কি
হইল । ডাক্তার ,কম্পাউন্ডার রে ত আইজ অব্দি চোখে দেখলাম না । জীবনে তো কোন সুবিধা
পাইলাম না । পানিতে ভাইস্যা ভাইস্যা ত জীবনটা শেষ হইয়া গেল ।'
ঠিক তক্ষুনি সুবর্ণ হাক পেড়ে উঠলো ' আর বোধহয় ধুবড়ি যায়া
পাইবে না '
সঙ্গে সঙ্গে সবাই মেঘের গর গর আওয়াজ শুনতে পেল ।
মতিহারির ভাতার , ফজলুল , সুবর্ণ , মরিয়ম বিবি বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা মতিহারি
,সবাই,সবাই শুনল।
মাঝি দুটো চিৎকার করে উঠল ,
'উই তুফান আইতাছে । নাওটা পাশের চরে চাপাইতে লাইগব '।
মরিয়ম মনে মনে ভাবল , কোথায় চাপাবে নৌকো ! আদি-অন্তহীন
ব্রহ্মপুত্রে ঝড়-বাদলে ঘিরে ফেলা দুলতে থাকা নৌকো , লবন ছিটান মাছের ছটফট করতে
থাকা মতিহারি – এই সবকিছু নিশ্চয়ই এর চেয়ে ভয়ের নয় । আসামের চরবাসিন্দা নাকি ও ?
বাচ্চাটা জন্মাবার জন্য একটু মাটি পাবে ত ?
ততক্ষনে মতিহারির ছেলের পা দুটো বেরিয়ে ঝুলছে । কিন্তু
ওর পায়ের তলায় কোন মাটি ছিল না । ছিল বৃষ্টির জল , ব্রহ্মপুত্রের জল !
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~