Saturday, 30 June 2012


                                সে , ওরা , আমি
                                                                      মূল অসমীয়া গল্প ঃ   প্রার্থনা শইকীয়া
                                                                       বাংলা রূপান্তর ঃ নন্দিতা ভট্টাচার্য
এক অদ্ভুত অস্থিরতা ওকে গিলে খাচ্ছে । বেরোতে চাইলেও বেরোতে পারছে না ।আবার এর ভেতরে ঢুকে থাকলেও মজা পুকুরের  মত ওকে নিঃশেষ করে দেবে। এই এক অদ্ভূত টানাপোড়েনের মধ্যে থাকতে থাকতে সে মাঝে মধ্যে ভীষন ক্লান্ত হয়ে যায়। সজোরে  প্রতিপন্ন করতে  চায় নিজেকে , নিজের স্থিতিকে । এরকম সময়ে সে সমমনস্ক বন্ধুবান্ধবদের দলে  ভিড়ে  যায়  নাহলে অস্থিরভাবে কবিতা লেখে ।  আর অন্য সময়গুলোতে এই টানাহেঁচড়ার চাপানউতরে সে একটি অদ্ভূত খেলায় ঢুকে পড়ে ।
ক্রিকেট ভদ্র লোকের খেলা তথাকথিত ভদ্রলোকের তালিকায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত না করলেও , ক্রিকেট ওর প্রিয় খেলা। ছোটবেলা , ওর গ্রামের অন্তরঙ্গ বন্ধুমহলে এক পাকা ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে ওর বেশ খ্যাতি ছিল। বাঁশের ফলা  নিয়ে মাটিতে পুতে স্ট্যাম্প বানিয়ে ওরা মহা আনন্দে খেলে যেত। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় বসার শর্ত হিসেবে চাওয়া ক্রিকেট ব্যাটটি  মা ওকে পরীক্ষার পর দিনই এনে দিয়েছিল। আর সে দিন থেকেই সে হয়ে গেল ওদের ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক। ......... এগুলো পুরানো কথা । ওর অতীতের বর্ণময় স্ন্যাপ’শট এখন এগুলো কথা মনে হলে নিজেরই কেমন  হাসি পায়। মদের আড্ডায় হঠাৎ করেই সে অতীতের কথা বলার চেষ্টা করলেই ওরা চেচামেচি শুরু করে ।
‘বাদ দে, বাদ দে , মলুয়া (বন্ধুরা আমাকে মলুয়া বাঁদর বলে ডাকে) তোর  অতীত রোমন্থনটা  এবার দয়া করে বন্ধ কর ।‘
                       ও   চুপ করে যায় । তিন আঙ্গুল মাপের পেগের তলায় সে ঝাঁপ দেয়। ও এখন ওর পুরনো স্মৃতি নিয়ে পুরনো ক্রিকেটের মাঠে । নেশা বেশি হলে কখন  বাঁ হাত টা ওপরে তুলে চিৎকার করে – দে’টস  আউট ‘ বলে
আবেগিক মুহূর্ত গুলোতে সে নিজেকে একটি পরাজিত ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক বলে ভাবে। নিজের ভেতরে পাক খাওয়া  পরাজয়ের প্রতিটি মুহূর্ত ।  রি’ক্যপের সময় সে নিজের ভুল নিজেই নির্ধারণ  করে । আবেগের মুহূর্ত বেশি হল  অবশ্য  নিজের ভুলকে শূন্য বা শূন্যের সমতুল্য বলে ধরে ও প্রতিপক্ষের দোষ খুঁজে খুজে ‘গোবর’ বলে গালাগাল করে।   আম্পায়ারের দোষে খেলার মাঠে অনধিকার প্রবেশ করা  গোল কিপার , প্রতিপক্ষের সস্তা আক্রমণাত্মক নীতির শত ছিদ্রের মধ্যে থেকেও  ওর টিমের সবচেয়ে দক্ষ অথচ সর্বহারা ব্যাটসম্যান ও স্ট্যাম্প বদলানো হেলমেট না থাকা ওর কৃষক বন্ধুর মাথা লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা  প্রতিপক্ষের বলের মত  --সবাইকে সে ‘গোবর’ গাল দিয়ে নিজের আবেগের সাগরে ডুবে  থাকে । ওর এমন আবেগের মুহূর্তের স্থায়ীত্বকাল সল্প । কিন্তু  সজোরে ওর হৃদয়ের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে ।   কখনবা  ঝমঝম বৃষ্টিতে , কখনবা ঠা ঠা রোদ্দুরে কখনবা বোমা  বিস্ফোরণে মৃত একশ একষট্টি জনের স্মৃতিতে ; টেবিলের সামনের  দেয়ালে চে’র ছবিখানার  দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কখন যে সে  আবেগিক হয়ে উঠবে তার কোন নিদৃষ্ট সময় ,কারন-অকারন,সকাল-দুপুর, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই । আবেগের নেশার ওপরে ঢেলে দেয় কোয়ার্টার বা হাফ বোতল  ম্যানসন হাউস ,নাহলে নাম্বার ওয়ানের এক একটি লার্জ পেগ । আর পয়সা থাকলে রিচার্জ কার্ড কিনে ফোন করতে থাকে , সেই  মুহূর্তে ওর যাকে যাকে মনে আসে তাকে তাকে ফোন করে । ওর বন্ধুদেরকে –‘নমস্কার, দুঃখের ছায়ায় যদি একটুক্ষন না জিরোও তাহলে সুখের পাখী কোথায় এসে বসবে!......কি খবর বন্ধু...আমি তো বিস্মৃতি গর্ভে লীন হয়ে যাওয়া এক মাতাল প্রেমিক। ...জিজ্ঞেশ তো করতে পার কেমন আছি আমি !’                       
কখনবা সে বসন্তের মত চির  সবুজ হয়ে থাকে কখনবা  শো শো শব্দে বাতাসে ভেসে বেড়াতে চায় । শহরের একটি ব্যস্ত অঞ্চল  থেকে অন্য একটি ব্যস্ত অঞ্চলে রিক্সা করে ঘুরে বেড়ায় । গোল্ড ফ্লেক বা নেভিকাট ঠোটে নিয়ে আবার রিকশওালা কেও যাচে নেবার জন্য । তিনআলি বা চারআলির রাস্তার কোনের দোকানে বসে লিকার চা খায় , আবার রিকশাওয়ালা কেও খাওয়ায় । মার কাছ থেকে দরকার হলে বেশি পয়সা চেয়ে সে এভাবে গোটা বিকেলটা কাটায় আর রাতে বন্ধুর সঙ্গে মদের আড্ডায় ওর প্রিয় কবিতা আওড়ায় ---
             ‘...... আমার ভাবী স্ত্রীর শরীর ঢাকার দাম আমার খোরাকি খরচের সমান
             ভাবা যায় আমাদের বেচে থাকা ...
             তবু আমি ভালবাসি উলঙ্গ শিশুটির হাঁসি, পুরানো
            পৃথিবী নতুন হয়ে ওঠে আমার ক্ষুধার্ত চোখের সামনে
            সুন্দরী রমণীর হাড়ের কাঠামো সময়ের ভেতর
            দিয়ে চিতার দিকে চলে যায় আমি  দর্শনের 
            মোটা বই বিক্রি করে কিনি রুটি ও মদ
            শুধু বেচে থাকার জন্য এমনকি কখনো লিখে ফেলি
            বিশ্বাস করুন লিখে ফেলি অনাবশ্যক কবিতা......’
জীবনটা  ওর জন্য  হয়ে ওঠে অনন্য  । নিজের খেয়াল-খুশি ,ইচ্ছে-অনিচ্ছের পথ ধরেই পার হয়ে যায় সোনালি জীবনের প্রতিটি পল, প্রতিটি অনুপল।  বেহিসাবি জীবনের ‘বিন্দাস’  ঠিকানায় ও গড়ে তোলে ‘বেপরোয়া ‘ একটি জীবন । পাঠ্যক্রমের বই বিক্রি করে পাওয়া পয়সায় ও কেনে হুমায়ুন আহমেদের বই বা বুকে পুঞ্জিভুত জমে থাকা হাজার তাড়নায় যখন কোন  আড্ডায় যোগ দেয়, তখন ওর  হঠাৎ মনে হয় ---‘সামর্থ্য থাকলে কি না করতে পারত এই হতভাগা মানুষগুলো । একটু ক্ষমতার দরকার,একটু  সামর্থ্যর প্রয়োজন
                                                    ২
     ‘রিকশাওয়ালাকে সমর দশ টাকা দেবে না বলল। তর্কাতর্কি লেগে গেল ।সমর রিকশাওয়ালাকে মারধোর করল । কাছের গুমটি দোকানে বসে ও দেখছিল বোধহয়। রিকশাওয়ালাকে মারার সময়েই ও সমরকে ধরে আচ্ছা করে পিটুনি দিল।  সঙ্গে ধন ও সামসুলরাও ছিল। পুলিশ সবগুলোকে ধরে নিয়ে গেছে। ‘ –আসিফ ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল । মানুষটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে । ‘’এই ছেলেটার জন্য আমার এক দণ্ড শান্তি পাবার উপায় নেই ।‘ –বলে ভেতরে গেল বাবাকে খবরটা দেয়ার জন্য প্রথমে ‘যাবনা’ বললেও  সন্ধ্যের দিকে বাবা থানায় গেলেন। লক আপের মধ্যে ও, ধন, সামসুল আর একটা লক আপে আগের থেকে রাখা কিছু অচেনা বন্ধুদের মধ্যে ততক্ষনে ভাব বিনিময় শুরু হয়ে গেছে ।
‘রিকশাওয়ালাটাকে পয়সা কম দিল বলে মানুষটাকে মেরে কি তুই সাম্যবাদ আনতে চাইছিস এই তোদের মত কিছু  অকর্মণ্যর জন্যই এই আদর্শে ঘুন ধরেছেকথাগুলো  মনে রাখিস ।‘---ওর বাবা ওকে এ কথা কটাই বললেন।
     কোথায় যে ভুল হল তিনি আর ভেবে পান নাতার যতটুকু  দিতে পারার  সবটুকুই তো তিনি দিয়েছেন   তাকে সম্পূর্ণ ভাবেই গড়তে  চেয়েছেন কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে, ক্রিকেট খেলবে বলে স্কুল পালানো ছেলেটিকে আজ পর্যন্ত তিনি ছুঁতে পরলেন নাওর প্রত্যেকটি আব্দারের সংগে সঙ্গ দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত। তেতো-কষার এক অপরূপ সংমিশ্রণে তার সংসার চলছে । স্কুলে চাকরি করেন ।স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বা তার নিজের ছোট ছেলেকে আজকাল তার ভাল-মন্দের ধারনা গুলো  দিতে সঙ্কোচবোধ করেনহয়তবা বড় ছেলের মত  এক অদ্ভুত যুক্তিতে ওনাকে খারিজ করে দেবে । ছোটবেলা যখন ও নিজের বিচার-বিশ্লেষন তুলে ধরে নিজের ভাবনা চিন্তাগুলো প্রকাশ করতো  তখন ওর বাবা চমকে উঠতেনকিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে  ওর প্রত্যেকটা ভুলের সপক্ষেও যখন ও যুক্তি দেখাতে লাগল তখন বাবা আর ওর কথা গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না। কিন্তু মা কি করে ওর কথাকে ,ওর ভুলগুলোকে ,ভুল আবদারগুলোকে একেবারে উড়িয়ে দিল! ওর বাবা অবসর নেয়ার পর এক জনের আয়ে আর সংসার চলছিল না । তবুও ওর কলেজের ফিজ বা  বই কেনার পয়সা জুগিয়ে গেছেন। ওদের মনে হত সে যা চায় তাই দিয়ে দিলেই হয়ত সে শুধরে যাবে । ...।এর পরেও মারপিট করে থানায় যাওয়া কমে নি ।  অব্যাহতি মেলেনি বাবার থানায় গিয়ে জামিনে ছাড়িয়ে  আনা-ও ।  .....ওনার অসহ্য লাগে । নিজের ওপরে রাগ হয় ।অনবরত রাগটা বিষাক্ত  কীটের মত তার মগজে আক্রমন ঘটায় ।
  .......‘আমার টাকা লাগবেবই কিনব ।
কোন জড়তা না রেখে সে রান্না ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল আগেরদিন বাজার থেকে আনা মিষ্টিকুমড়োর ডাটিগুলো কাটতে কাটতে মা জিজ্ঞেস করলেন---
‘কত?’
‘একহাজার’
 মাথায় বাঁশপাতার পোকাটি কিলবিল করে উঠল ।
‘লজ্জা নেই তোর ‘ ঝগড়া করে জেলের ভাত খেয়েও  লজ্জা হয়নি তোর! বই কেনার টাকা চাই তোর ! এই এক মাস হল তুই বই কেনার জন্য টাকা নিয়েছিস !মারামারি করতে করতে গুন্ডা হয়েছিস তুই ! বই পড়ে আর পণ্ডিত  হতে হবে না তোকে !
‘ রিকশাওয়ালাটাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিলে ভাল হত, না ? নিজের খিদের ভাত রেঁধেই কাত হয়ে যাচ্ছ , রিকশাওয়ালার শ্রমের মুল্য তুমি কি বুঝবে ?
পা দিয়ে এক ধাক্কায় বালতি সরিয়ে সে ঘর থকে বেরিয়ে গেল। ওর ভাল লাগা  মিষ্টিকুমড়োর  ডাটিগুলো এক  টান মেরে মা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিলেন ।
                                          ৩
                                
                                  ‘ ......... দুঃখের সাগরে
                                    নৌকো বেয়ে যাব
                                  ঝড়ে ক্লান্ত হয়ে
                                    বৈঠা  হারাব।   
                                 দিশা খুঁজব
                                 স্রোতের বিপরীতে নৌকো বাইব
                                  বেঁচে   থাকব বলে
                                   বেঁচে আছি বলেই
                                   উচ্ছিষ্ট চাটিনি   ......’  
ভণ্ড ,বুর্জোয়া মানসিকতাকে গালাগাল করতে ওর কোন ক্লান্তি  আসে না । ছোটবেলা বাবার মুখ থকে পাওয়া ‘কমরেড লাল সেলাম ‘-র  যে আদর্শ  ওর হৃদয়ে গেঁথে আছে তাকে আঘাত করা প্রত্যেকটা লোককে সে  ঘৃণা  করে! অন্তর থেকে । মায়ের প্রতিও ঠিক এ রকম একটি অনুভূতি পুঞ্জীভূত হয় । ওর রাগ হয় মায়ের ওপর । কথায় কথায় ওকে ঠাট্টা করা আদর্শবিহীন গৃহিণী জীবনে তার পুত্রের ধিক্কার ।  গৃহকর্ম আর স্কুলে যাওয়া আসা ছাড়া  কি-ই বা কাজ আছে মায়ের । কথায় কথায় আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার বাইরে একটিও ভাল কথা মা আজ পর্যন্ত বলেছে কি? ...।।অসহ্য লাগে  ওর । অসহ্যকর একটি মাথাব্যথা ওর মগজকে কুরে কুরে খাচ্ছেবাড়ীর বাইরে বেরিয়ে সে সামসুলের খোজ করে । ধনর পকেটের পয়সায় একটা ফুল ও একটা  হাফ বোতল কিনে ওরা অঙ্কুরের ভাড়াবাড়িতে গিয়ে ঢোকে । পুর রাতটাই ওরা মদ ও সিগারেটের ধোয়ার আবেশে  নিঁখোজ হয় ।  অন্য একটি পৃথিবীর সন্ধানে ও মদ গিলতে থাকে ।  আবার আবেগে ভাসতে থাকে।  অসংলগ্ন ভাষায় আবার আম্পায়ারকে গালাগাল করতে থাকে----
--‘শালা, শুয়োরের বাচ্চা ! আম্পায়ারগিরি দেখাচ্ছিস ,হ্যাঁ ! তোর নির্দেশে সমস্ত পুঁজিবাদী শাসক ঢুকেছে । আমার প্রতিপক্ষ ,শালা। ওদেরকে ইশারা করে আমার সর্বহারা খেলোয়াড়দের শুষে খাচ্ছিস ---ভাগ, শালা শুয়োরের বাচ্চা ,ভাগ,.........তোদের সব আউট ,সব আউট.........’   
মদের নেশায় যতক্ষন সে আউট না হয় ততক্ষন বকতে ই থাকে। মায়ের মুখটা মনে এলে ও সিগারেটের  ধোয়ার ধুম্রজাল তৈরি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে । ...... আর বাবার কথা মনে পড়লেই ও খুব  অস্থির হয়ে ওঠে । শৈশবের ক্রিকেট  গ্রাউন্ডের  মত অন্য একটি গ্রাউন্ডে সে বাবার হাত ধরে এগিয়ে যায় ।  পার্টির ‘হো’লটাইমার ‘ জাগাদিশ কাকা ও বাবার  সঙ্গে সে বাবার তর্জনী  আঁকড়ে ধরে হাটতে থাকে । কাশবনের  মাঝখান দিয়ে ওরা চরের মধ্যিখানে বাস করা  কয়েক ঘর মানুষেরর দিকে এগোয় । মানুষগুলোর সংগে বাবারা কথা বলতে থাকে ।কথা গুলো বুঝতে না পারলেও মন দিয়ে শুনছিল  ও ।ইতিমধ্যে সন্ধ্যে নামল ।বাড়ী ফিরে মিষ্টি কুমড়ো ভাজা খেয়ে কোন একটি ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়ল ওরা । ......... সকালবেলা ধন যখন ওকে জোরে জোরে ডেকে ঘুম ভাঙ্গাল , সে ধড়মড় উঠে  দেখল সেই একই পৃথিবী রয়েছে ,একই মানুষ, একই ক্রিকেট খেলা , একই ম্যাচ ফিক্সিং , একই পুঁজিবাদের অনধিকার প্রবেশ , ......একই , সব কিছুই এক......সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল । ধনর কাছ থেকে একশ টাকা নিয়ে সিটিবাসে ওঠে । কলেজের সামনের ‘দাদার দোকান’ থেকে একটা ফ্লেক ধরিয়ে উদাস দৃষ্টিতে  কলেজের দিকে তাকিয়ে থাকে  ব্যস্ত হয়ে হেটে যাওয়া  মানুষগুলোর দিকে ।  ...... হঠাৎই  ও সিদ্ধান্ত নেয় -----‘ কিছু একটা করতে হবে ; অন্তত পক্ষে রিকশাওয়ালা ঠেলাওয়ালা জনগণকে সন্ধ্যেবেলা লেখা পড়া শেখাবে .........কাজটা খুব শীগগির শুরু করতে হবে । ওর ছাত্রসংগঠনের ছেলেদের ও আরও বন্ধুবান্ধবদের কথাগুলো বলতে হবে । ,
         ঠিক  তখনই তাকে দেখল । ব্যস্ত পায়ে ইলিয়ট ,সেক্সপিয়ার ,ব‍্যগে ভরে দ্রুত  হস্টেলে ফিরছে সে । ওর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল । হঠাৎ ও চঞ্চল হয়ে ওঠে । তাড়াতাড়ি ফুটপাথ থেকে নেমে তার সঙ্গ ধরে ----
   ‘নমস্কার,  দুঃখের ছায়ায় একটু সময় না জিরোলে , কোথায় বসবে সুখের পাখী । কি খবর বন্ধু ? আমি ত স্মৃতি বিচ্যুত এক মাতাল  প্রেমিক । জিজ্ঞেস ত করতে পার কেমন আছি আমি !’
                                                       ৪
সে ওকে  যতখানি জানে সেই নিরিখে যদি  মাপতে যায় তাহলে ওর দশভাগের এক ভাগ জানতে পারবে । তবুও সে যতটা জানে ততটাই  যথেষ্ট বলে ভাবে --- সে ওর সঙ্গে একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত । অর্থাৎ দুজনে একই মতাদর্শে বিশ্বাসী । ও মাঝে মাঝে মদ খেয়ে মাতলামি করে , আবার কলেজ নির্বাচন গুলোতে যে নিরন্তর ঝগড়াঝাঁটি চলে তাতেও সক্রিয় অংশ গ্রহন করে ; ও কবিতা লেখে , মাঝে মাঝে বিভিন্ন পেপার-ম্যাগাজিনে সেগুলো  প্রকাশিত হয় ; ওর একটা বৃহৎ  বন্ধুমহল আছে  ,ওর বন্ধুবান্ধবদের মতামত ওদের সংগঠনের সঙ্গে মেলে  ইত্যাদি ইত্যাদি । ওর সম্পর্কে সে এই খবরগুলো নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে । উপরন্তু কিছু খবর  ওর রুমমেট ওকে যোগাড় করে দিয়েছে । সেদিন সংগঠনের কাজ  শেষ করতে একটু দেরি হয়েছিল  --তারপর ও তাকে  বেশ রাত করেই রিকশা করে হোস্টেলে পৌঁছে  দিয়ে গিয়েছিল । আর সেই দিন রাতেই, আমার রুমমেট রাতে ভাত খেয়ে উঠেই, তাড়াতাড়ি তাকে বসিয়ে ওর সম্পর্কে জানা আরও খবর উগরে  দিতে লাগল ----
      ‘ দেখ চাকি ! তোর মা বাবা এখানে তোকে পড়তে পাঠিয়েছে , পড়াশুনো মন দিয়ে কর । ...... ও- যে কি খারাপ ছেলে তুই জানিস না । গত বছর ওর সঙ্গের একটি ছেলেকে মজা করে ক্ষ্যাপানোতে সে ঐ ছেলেটিকে মেরে হসপিটাল পাঠিয়ে  দিয়েছিল ।পুলিশ ওকে খুঁজতে এসেছিল । এগুলো কলেজের সবাই জানে ! তারপরেও ওর  রেজাল্ট দেখেছিস তো ? সেকেন্ড সেম দেয়নি । ও যে নিজেকে কি  ভাবে !......তুই ওর থেকে অনেক ভাল ছেলে পাবি, জানিস ?’
   ...... তবুও সে ওর কথা ভাবে !তার সঙ্গের  মেয়েরা যখন তাকে সি ,সি, ডি ‘র রঙ্গিন আড্ডাতে নিয়ে  যায় , তখন তার  ওর কথা খুব মনে হয় । কিন্তু কফির কাপে চুমুক দিয়ে কিম্বা ওর রুমমেটের ছেলে বন্ধুদের  শপিং মলের  বাইরে থেকে কিনে দেয়া পপকর্নের প্যাকেট হাতে নিয়ে  সে উপলব্ধি করে ‘ আসলে ওর রুমমেটের কথামত ও একটি খারাপ ছেলে । তাকে  সুখী করার মত , বা তার ইচ্ছে পুর্ন করার মত কোন ক্ষমতা ওর  নেই , ও খারাপ ছেলে  র নিজের কন ভবিষ্যত নেই  । তাহলে অন্যের ভবিষ্যতের দায়িত্ব ও কি করে নেবে?  ও মদ খেয়ে মারামারি করে । ...।।কবিতা লিখতে পারে বা সাম্যবাদ নিয়ে বড় বড় বুলি ঝাড়তে পারে  , কিন্তু  ও তোকে ধোকা দিচ্ছে  মাত্র । ওর সঙ্গে গিয়ে কি সে একটা উশৃঙ্খল জীবন যাত্রা বেছে নিতে চাইছে ? ‘...... অনিচ্ছাসত্বেও বাজতে থাকা  মোবাইলটা সে  হাতে তুলে   নেয়---
 ‘হেল্ল ‘।
  ‘ কি খবর ...... আজ অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম। একটা খুব জরুরি কথা তোমায় বলার ছিল । আমার তোমাকে ভাল লা......’ ‘অহ’!(সে ওকে বাক্যটি  সম্পূর্ণ করতে দিল না )  বাড়ি   থেকে   ফোন করছে । ‘ওয়েটিং –এ  আছে কলটি । আপনি প্লিজ পরে চেষ্টা করুন । ‘
একটু পর ও আবার ডায়েল করল ওর প্রিয় নম্বর ৯৯৫৪১......
তাকে অতিষ্ঠ কর তুলল  অসহ্যকর সেই কণ্ঠস্বর ---‘দি এয়ারটেল কাস্টমার ইউ আর ট্রায়িং টু কল ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ । প্লিজ কল আফটার সাম টাইম ।‘
                                                   ৫           
      অতিষ্ঠ হয়ে ও হাত থেকে মোবাইল ফোনটা মাটিতে আছড়ে ফেললো । বাড়িতে ফিরে  যাওয়ার কথা ভেব ও চুপ করে বসে রইল । অঙ্কুরের ভাড়া বাড়িতে বসে ও মদ খাওয়ার কথা ভাবে । প্রচণ্ড একটি  অভিমান ওর বুকে জমা হয়েছে,  জেগে উঠছে এক গভীর বিষাদ-সিন্ধু ওর  মনে । সে  জীবনকে নিয়ে   মগ্ন হল  ,জীবনকে মেপে দেখতে চাইল  ----  দৈর্ঘ ও প্রস্থে , প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিতেকিন্তু ও যে ভুলে যায় পাটীগণিতের হিসেব ;যাপন করে এক বেহিসেবি ,বেপরোয়া  জীবন এবং আবারও ব্যর্থ হয় । ও ভাবা সত্যি কথাগুলো বার বার কেন মিথ্যে হয়ে যায় ---সাম্যবাদ থেকে শুরু করে  ওর জীবনের ছোট  ছোট ঘটনা গুলোতে অবাঞ্ছিত প্রতারকের দল অনধিকার প্রবেশ করে ওকে  নিঃশেষ  করে দিচ্ছে । সুরক্ষিত ভবিষ্যতের পূর্ব শর্ত পালন করতে পারিনি বলে আমি এক ব্যর্থ প্রেমিক। ও আবার উদ্বেলিত ,ভাসমান । সদ্যসামাপ্ত ক্রিকেট খেলার পরাজিত দলের অধিনায়ক হিসেবে প্রেস বিজ্ঞপ্তি  দেয়ার কথা ভাবে ---- ‘ আসলে আবহাওয়া আমার অনুকুলে ছিল না । টসে হেরে প্রথম ব্যাটিং করার জন্যেই এমন হল । প্রতিপক্ষকে সঠিক উত্তর দেবার সপক্ষে আমাদের সর্বহারা দলটির কাছে আসলে কিছু  ছিল না ---- জীবন সুরক্ষার জন্য বিজ্ঞান সম্মত ভাবে তৈরি হেলমেট , রান নেওয়ার জন্য দৌড়ানোর সামর্থ্য ,একজন  শক্তিশালী খেলোয়াড় হওয়ার জন্য পুষ্টিকর আহার ...... আমাদের এগুলোর কোনটাই ছিল না । ...... অথচ সব আছে ভেবে বোকার মত আমরা ময়দানে নেমে পড়েছিলাম ।
এক অসহ্য রকমের মাথা ব্যথায় ও কুঁকড়ে যায় , ওর ঘিলুটা যেন কে নিংড়ে নিচ্ছে তিন পেগ শেষ করার পরেই ও আম্পায়ারকে গালাগাল দিতে শুরু করে ---- ‘ শালা প্রেমের বাজারেও নিলাম হয় আমার অনুভুতি । ধূর্ত আম্পিয়ার ! প্রেমের বাজারেও তুই ব্র্যাণ্ডেড বর সাজিয়ে সাজিয়ে পাঠাচ্ছিস ।  সব তোর পুঁজিবাদী চাল , সব তোর ইশারায় চলছে !...শা...লা আম্পয়ারগিরি দেখাতে এসেছিস  হাঃ , তোর ঈশারাতেই অনুপ্রবেশ ঘটেছে পুঁজিবাদের ...... শালা সব ব্রান্ডেড ------ব্যাট , বল , জুতো , বর ...... শা...লা তদের অঙ্গুলির নির্দেশে আমরা সর্বহারায় পরিনত হয়েছি ---- ভাত, ঘর, ইজ্জত, প্রেম সব তোরা শুষে নিচ্ছিস ......শ।।লা ... কুকুর ,ভাগ ,ভা – গ , শা ... লা... এখান  থেকে ।‘
পরেরদিন আবার সামসুলের কাছ থেকে একশ টাকা ধার করে।  রিক্সা করে  উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে একটি ব্যস্ত অঞ্চল থেকে অন্য একটি ব্যস্ত অঞ্চলে ও ঘুরে বেড়াতে লাগল । মাঝে  মাঝে  একটু লিকার চা ,একটা  বিড়ি বা সিগারেট ।  রিকশাওয়ালাকেও খাওয়ায় । অনেক কাজ করার কথা ভাবে সে ! ...আবার ভেসে যায় আবেগে ...। বসন্তের মত সবুজ হতে চায়—সুবাতাস হয়ে ভেসে থাকতে চায় একটি সুন্দর সুরের মত......
 পরিশিষ্ট
   জসমি, পম্পি , চাকির  অযৌক্তিক প্রত্যাখ্যানের পর সে  অনেকবার মদ ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছিল । সিগারেট ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছিল। এক সপ্তাহ পর পর চান করা ছেড়ে প্রতিদিন চান করার কথা ভেবেছিল । ... কিন্তু এত সহজে কি সব বদলে ফেলা যায় !সেটা সামাজিক  পরিবর্তনই হোক বা ওর মনের গতিরই হোক !ওকে আমি সঠিক অর্থে  বুঝতে পেরেছি বলে দাবি করছি না । কিন্তু বন্ধু হিসেবে সে যখন আমাদের তার অসন্তুস্টি ও অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস ঝরায় , তখন বার বার ই  আমদের আলোচনা হয় ওকে নিয়ে।
১ম  বন্ধু---  ও আসলে বড় আবেগে ভাসে । কিন্তু আজকালকার মেয়েরা তো এত আবেগ নিয়ে চলে না , ওরা প্র্যাক্টিকাল ছেলে খোঁজে । প্রেমিক হলেও ওকে প্রাক্টিকাল হতে হবে, সিসিডি , বারিস্থা , মাল্টিপ্লেক্সে নিয়ে যেতে হবে । আর যাই বলিস না কেন সাম্যবাদী প্রেমিকাও শালা একই ......আদর্শকেও ওরা ট্রেডমার্ক হিসেবে ইউজ করে ।
২য় বন্ধু---এই বাদ দে ওর  প্রেমটেমও আসলে সবসময় মধ্যমনি হয়ে থাকতে ভালবাসে আর এই জন্য এতরকমের বাহানা বার করে ।
৩য় বন্ধু--- কিন্তু মার কাছ থকে ফাঁকি দিয়ে  পয়সা  নেয়াটা কেমন কথা ।মা-বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে মারা !
৪র্থ বন্ধু--- বাদ দে তো! ও এক  স্বপ্নের জগতে বাস করে । আদর্শের ক্ষেত্রে বা প্রেমের ক্ষেত্রে ও ভীষণ ডিভো’টেড  !...... ও নিজের মত করে বাঁচতে চায় , এই ধর—স্নেহ-ভালোবাসা , সাম্যবাদী সমাজ , প্রতিবাদের ভাষায় লেখা কবিতা , এগুলোই ওর বাঁচার রসদ ।
... আমি সব সময় চুপচাপ থাকি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করি । কখন কখন এ রকম আলচনায় অংশ নেই ।বিশেষত যখন তিনটে  লার্জ পেগ খাওয়ার পর ওর  কথা ওঠেখুব সাবধানে  মন্তব্য করি । ---
আমি ঃ এক অদ্ভুত অস্থিরতা ওকে গিলে খাচ্ছে । বেরোতে চাইলেও বেরোতে পারছে না । এই অস্থিরতা ওকে গ্রাস করে,    তলানিতে এনে দাড়  করায়  । আর এই অস্থিরতার  টানাপড়েনে ও  ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে নিয়ত......... ।
§  গল্পটিতে উদ্ধৃত প্রথম কবিতাটির অংশ ‘হাংরি জেনারেশনে’র  বিখ্যাত বাংলা কবি ফাল্গুনি রায়ের কবিতা থেকে নেয়া ।
                                        ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

Friday, 25 May 2012

কাঁটাবন

 বার বারই ভাবি যথেষ্ঠ হয়েছে  আর নয় --সঙ্গে সঙ্গে পাঁজরের তলায় একমুখ উগরে লাভা,  চোখ পাঁজরের ভেতরে সেঁধিয়ে ছটফট  , শিরাগুলো টান টান ,দপ দপ কপালের রগ্‌ , এক টুস্কিতে সারা গা বেয়ে নেমে আসবে রক্তের ধারা , অথচ কি আশ্চর্য মন থেকে সে তো বৃষ্টিতে ভিজতেই চেয়েছিল , ভিজবে বলেই ধেয়ে আসা অঝোরকে কখনও জড়িয়ে ধরেছে কখনও পাশ কাটিয়ে গেছে  পাশ কাটিয়ে গেলেও ছাট এসে তো  গায়ে  লাগে ।
আবার ঈশ্বরকে যত আকড়ে ধরতে চেয়েছে বার বার ঝড়ের ঝাপটায় দূরে সরেছে , আস্তে আস্তে ভীষণ পর মনে হয়েছ  তাঁকে , যত দিন গেছে শয়তানের সঙ্গেই ভাব  হয়েছে , অন্তত পক্ষে তাঁর একটি স্ফটিক চেহারা আছে ,বাকা আঙ্গুলে ঘি তোলার দর্শন  নেই ,সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলে দৃঢ় ভাবে , নাম ভাঁড়িয়ে নিয়তি নিয়তি খেলায় মানুষকে ঠেলে দূরে বসে মজা দেখেনা ,  ঈশ্বরের কাছে কোন পাকা হিসেবও নেই , যুক্তি  দিয়ে বোঝাতে পারবে না তার খেলার খতিয়ান ,কেন বৃষ্টির বদলে রক্ত  , ভারি মহানের বড়াই ! ঢের হয়েছে বাপু  আর নয় বললে তো সে তোমার পিছু ছাড়বে না বার বারই বাড়িয়ে দেবে কাঁটা সহ একটি  ডাল , রক্তাক্ত তোমার হাত , ঘেমে উঠবে তুমি রক্ত চানে , তোমায় নিদান দেবে বৃষ্টি তো সবার জন্যে নয়,  চণ্ডী তৈরি করার  খেলায় অন্নপুর্নার  হার তো হবেই  ।
একটি সোজা আলপথ ধরে যতই  এগোও পথের পাড়ে জরি চুমকির সালমা কাজের জন্যে ক জীবন অপেক্ষা করতে হবে তা কোন খেরোর খাতায় লেখা নেই ;নিরেট লাল সুতোয় বোনা আল ধরে ছুটে চলা অন্তহীন ...।

Wednesday, 9 May 2012

বুদ্ধের হাসি কান্না

বুদ্ধ হাসেননি কখনো
অথচ তাকে হাসানো হল
যেমন যুদ্ধের আয়োজনে কুকুরের লেজ
নাড়ালেই নড়ে ।


বুদ্ধ হাসেননি কখনো
বুদ্ধ হাসলেই পৃথিবীর চোখ কানা
বুদ্ধ হাসলেই পৃথিবীর চোখে টপ টপ জল
বুদ্ধ হাসলেই পৃথিবীর শরীরে গ্রহন ।
অথচ মহাভিক্ষুর শূন্য ঝোলায় নিদ্রিত পরম অনু
যার তিল তিল বিস্তৃতি এক গহিন ডুব
শান্ত শীতল দীঘির পুর্ন চন্দ্রমুখ ।
বুদ্ধ কাঁদলেই পৃথিবীর সুখ ।

কৃষ্ণগহ্বর


কৃষ্ণগহ্বরের দিকে পুনর্যাত্রা দুখি মানুষের
যদিওবা কয়েকপা হেঁটেছিল দূর সংগবদ্ধ
রক্তের সিঁড়িতে পা আটকে আবার পিছুহটা
এ রক্তক্ষরন তো নীরব, দু'দশকের সরব শীত
দিয়েছে নিদান, নিরানব্বই শতাংশের রক্ত ঘাম
গড়ে দেবে পৃথিবী কুলীন ,মননের সীমানায়
ঘাটি গাড়ে স্থবির বিকেল ,সুর্যোদয়ের আকাশ আজ
বিবর্ন বিহ্বল, সারিবদ্ধ পঙ্গপালের নিভৃত চারনভুমি ।

প্রকৃতির তীব্র ঘৃণা শূন্যতার প্রতি 
রাতের অবিশ্রান্ত পরিক্রমাই উজ্জ্বল দিনের উল্লাস ।
~~~~~~~~~~~~

Saturday, 28 April 2012

বিষকন্যা

সুজাতার পরমান্ন ভাণ্ডে ঢেলে দেব
একফোঁটা বিষ
যেমন গাছের গোঁড়ায় পেরেক কিংবা হিং
কঙ্কাল গাছের সারি ঠায় দাঁড়িয়ে
করাতের অপেক্ষায় ।

আমি তো বিষকন্যা ।

সমস্ত অপকথা গায়ে মেখে
উদোম দাঁড়িয়ে থাকব পেরেক বুকে ।
· · 8 minutes ago ·



Friday, 6 April 2012

অনাস্থার ইতরতা

মুখে কাপড় গুঁজে দিলেই কি আস্থার শেকড় গজায় ,শব্দ ব্রহ্ম মেঘের উর্মিমালা বিশ্বাসের গোঁড়ায় জল , কাকের পরিভাষায়ও কোন ইতরতা নেই ,শুধু নিজের চারপাশে বেড়ে ওঠা আরশিনগরে জল সিঞ্চন , তাতে নিজের মধ্যে জেগে ওঠে এক মৎসকন্যা, সে জল বলয় বিচ্ছুরিত আলোর পলাশ রেনু ,শব্দের নিস্তব্ধতায় ক্লান্ত বা অসত্যের মাপকাঠি , আরশিতে পড়শি যাপন কখনই ইতরতার বিকল্প নয় ,মননে লক্ষ্মীন্দরের বাসর ঘর , কলার মান্দাসে বেউলোর অন্তহীন যাত্রা অব্যাহত ।

Thursday, 5 April 2012

নোনাডাঙ্গায় বাতাসের আগে আগুন ছোটে
ইলেকট্রিকের অস্তিত্বহীন তারগুলো একলা
এখানে ওখানে ঘাড় উল্টে পড়ে জল বিন মাছ
সরসর শব্দে বাতাস একা একা হাঁটে  হ্যাংলা
ডাঙ্গায় ,খবর চুপিসাড়ে জানান দিয়ে যায়
আজ রাতে বিলাই বিলাইয়ের মাংসে থাবা ,
ঘাড় ও মটকে দিতে পারে, সচেতন বায়সেরা
আয়েশে বসে  মাংস চিবায়; তারহীন বার্তালাপে
জালিয়াতি কথোপকথন জারি,আত্মতৃপ্তির
চোঁয়া ঢেকুরে আগ্রাসী স্নান,অতঃপর তিলমাত্র
আঘাত চিহ্ন বহির্ভুত পরিব্যপ্ত পাখির চোখ
দু পেগ বিপ্লবে আস্থা রেখে কলিযুগ শানায় ,
সংজ্ঞা সব কিছুরই বদলেছে'ধর্মের'ও'জিরাফের'ও ।

              

Friday, 30 March 2012

আড়কাঠি


                                                         কালিম্পং ,দার্জিলিং পাহাড়েপাহাড়ে
                                                          চোখে চোখ ঠিকরায় ঘৃণার আবর্ত

                                                 বিভেদের কুনাট্যে পায়ে কুড়ুল,
                                                  ভাঙ্গ ও খেলিয়ে যাও , সাহেব
                                                  সুবোর ফেলে যাওয়া জুতোয় পা ,
                                                   ঠাট মেরে যতটুকু আটাতে চাও
                                                   খাপে খাপ ,বদলাবে না কিছুই
                                                   আরও পাঁচটি লুটেরা জমাটি
                                                    খেলায় পাশার দান সঠিক ঘরে,
                                                    নিমিলিত চোখের সরলতা জানবেও
                                                     না কেমন নিপুণ মাপে বসে যাবে
                                                     লোহার জুতো ,আগুনের ঘেরাটোপে
                                                      বনসাই ভালবাসা ,আমার তোমার
                                                      চোখের মনিতে আড়কাঠি ।
                                    
                                






Sunday, 19 February 2012

লে লে বু ছ'আবানা ...ভ্যালেন্টাইন মারিজুয়ানা

ভ্যালেন্টাইন খুড়ো আসছেন । সে কি আর না জেনে থাকতে পারবে ! প্রথমেই খবরের কাগজ লাফিয়ে পড়বে সাত পাতা জুড়ে ।প্রথম পাতাতে ই লাল লাল হৃদয়পুর আসন বিছিয়ে বসে আছেন । সঙ্গে গহনাগাটি । পিসি  এম পি অঞ্জলি সেনকো সারি সারি নামের বাহার । সোনাতে হচ্ছে না ।এখন হীরে জহরত ছাড়া চলছেই না । কত কুচি কুচি চ্ছটা দিয়ে মনিরত্মম। আমরা জনি এখন ৩-সি নাহলে বৃথাই সত্য যাচাই । ক্যারেট ,কাট ,কালার ।হু হু বাবা ।কম দিগগজ হয়েছি আমরা ! কোথায় কে না খেতে পেয়ে মরেছে ভারি এসে গেল ! চালাও পানসি ভ্যালেন্টাইন । কাগজে বিজ্ঞাপনে আবার চারটি খাপ থাকবে ।প্রথম খোপে হীরে ,তারপর সোনা ,৩য় রুপো ,৪র্থ জাঙ্ক ।তিনি আবার ননী ,সোনার খনি। এরপর কত টাকার কিনলে কত কিছু মু্‌ফ্‌ত । ৪০ হাজার টাকার জিনিষ কিনলেই নাকি একটি  লকেট ফ্রি ।তার এক বিশাল ছবি দেখে আমার বন্ধু হাপাতে হাপাতে হাফ সি এল নিয়ে ছু্টল । পরের দিন দেখলাম মুখ বেজার ।জিজ্ঞেস করলাম হাকু পাকু করতে করতে যে গেলি হিরেমন কে ধরবার জন্যে তা এত মুখ বেজার কেন । বেজায় রেগে গেল ।এত বড়  ছবি দিয়েছে লকেটের এই ত্ত টুকুনি পুচকে একটা লকেট । জোচ্চোর কত গুলো !!তা তুই কি ভেবে ছিলি হরিশচন্দ্র ।গেল। ছোটাছুটি করে হিরে সোনা তো হল। এবার আর্চিস তো তার বাহার নিয়ে বসা ।কার্ড ,হাতের ব্যান্ড ।হ্যানা ত্যানা । চারিদিকে ভ্যালেন্টাইন বিজ্ঞাপনে শহর ছেয়ে আছে । জামকাপড় ,জুতো ,জুয়েলারি । ১৪ ই বিকেল রেস্তোরাতে লাইন ।  মাসের খরচ অবধারিত ভাবে বেশি । ঘরে ঘরে কর্তাদের মন খারাপ । আগে ছিল পুজো -পার্বন । দেয়া থোয়া । উরি স্যাটা এখন তো তিন চারটে উপদ্রব এসে জুটেছে । এরপর অক্ষয় তৃতীয়া । আবার গহনা গাটি । আর আসল ধামাকাতো ধানতেরাস ।তরাসে বুক ধাকড় পাকোড় । তখন ব্যাঙ্ক গুলো ঝাপিয়ে পড়বে । ৪ গ্রাম ,৫ গ্রাম , ১০ গ্রাম। ১৫ গ্রাম , গ্রাম গ্রাম ...।সোনার কয়েন ...কিনুন কিনুন ।সম্পত্তি । দুঃসময়ের সঙ্গি আখেরে কাজ দেবে । ছেলেমেয়েদের বিয়ে শাদি  মসৃণ । সঙ্গে আছে বাসন কেনার হিড়িক । মরন হল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ।সরকারিবাবুরা পে কমিশনে যা  দু চার পয়সা পেয়েছেন  কিছুটা  ট্যাক্স ও আর গেল বানিয়াদের গব্বগৃহে । তার জন্যি নতুন নতুন বাহানাবাজি । আই টি ওয়ালারা বাজারের ভারসাম্য রক্ষা করচেন । তাদের দিকে বানিয়া গোষ্ঠীর শ্যান চক্ষু ।
লে লে বাবু ছয়ানা সঙ্গে মুফতি খানা । তার জন্যে কত বাহানা । মরল ব্যাঙ্গের ছানা ..............................।     

                                         

Friday, 10 February 2012

হত্যা ~~



এটা কি ভালবাসার হত্যা
আমি তোমাকে একটু আগে দিয়েছিলাম
 ভালবাসার স্বাক্ষর
আমায় মারলে জন লেননকে যে ভাবে মারা হয়েছিল


তাহলে হত্যা আর ভালবাসার সম্পর্ক কি ?

মনস্তত্ত্ব না নৃতত্ত্ব
যেমন পণ্ডিত লেভিস্ত্রোচ বলেন ?
ঘটনার বিপ্রতীপ রূপান্তর ?

গভীর মনস্তত্বের বিষয়
ভালবাসা ও ঘৃণা
মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ

দুটোই কিন্তু এক ।
~~~~~
~~~~~
অসমিয়া কবিতা
হত্যা
~~
কিশোর ভট্টাচার্য
এইটু মৰম'ৰ হত্যানে
মই তোমাক অলপ আগতে দিছিলো
ভালপোৱাৰ স্বাক্ষৰ
মোক মাৰিলা যেনেকৈ জন লেননক মাৰিছিল

তেনেহ'লে হত্যা আৰু ভালপোৱাৰ
সম্পর্কটো কি ?
এইটো মনস্তত্ব নে নৃতত্ত্ব
যেনেকুৱা পণ্ডিত লেভিস্ত্রোচে কয়?
ঘটনাৰ বিপ্রতীপ রূপান্তৰনে ?

এইটো গভীৰ মনস্তত্বৰ বিষয়
ভালবাসা ও ঘৃনা
একে মুদ্রাৰ ইপিঠ-সিপিঠ

দু'টা বস্তু কিন্তু একোটাই।
~~~~~~~~~~~~~~~
বাংলা রূপান্তর ~~নান্দিতা ভট্টাচার্য

Saturday, 21 January 2012

দূরের নক্ষত্র

রকাশিত হল 'দূরের নক্ষত্র'-নন্দিতা ভট্টাচার্য'র
বাংলা কবিতা সংকলন ।
প্রকাশক ~~ভাষা সংসদ।
পাওয়া যাবে বইমেলায় । 'প্যাপিরাস' ,'অহর্নিশ' ,'অনুবাদ পত্রিকা' ,'কারুভাষ' ~র স্টলে ।

Wednesday, 18 January 2012

উরুকার রাত ,ভোগালি বিহু~~পৌষসংক্রান্তি



পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত । আসামে  বলে উরুকা । সেই রাতের জন্য হা পিত্যেস করে বসে থাকতাম আমরা সারা বছর  । এক মাস /পনের দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যেত তোড়জোড় । ভেলাঘর তৈরি করার সাজসরঞ্জাম জোগাড় করা চলত অনেকদিন ধরে । শহরে সব কিছুই সংগ্রহ করা বেশ কষ্টকর। কিন্তু ভেলাঘর তৈরি করতে চাই খড় ,বাশ, কলার শুকনো পাতা বা পাচালি। বাঁশ দিয়ে ঘরের খাঁচাটি তৈরি হবে, চাল হবে খড়ের, দেয়াল হবে কলার পাচালি দিয়ে । পাশে হবে মেজি। বিশাল খোলা মাঠে  তৈরি হত । ছেলেদের মধ্যে এই নিয়ে  দারুন প্রতিযোগিতা ।কার ভেলাঘর কত বড়।কার মেজি কত উঁচু ।  মেজি খড় বা কাঠ দিয়ে  তৈরি হত । সিলেটে বলা হত মেড়ামেড়ি। দাদাদের ভেলাঘর ও মেজি ঘর বিশাল কাণ্ডকারখানা ।আমাদের ছোটখাট ব্যাপার  । ছোট্ট একটুখানি ঘর ।মেঝেতে খড় পাতা  ।তাতে হুটপাটি দাপাদাপি ।চেঁচিয়ে গান গাওয়া ,কত রকমের গল্প । বন্ধুদের একসঙ্গে এতক্ষন থাকা ।রাতের  পিকনিকের তোড়জোড় ।
 সেদিন টি ছিল চুরিরও রাত। কারোর বাড়ির পাঁচিল বেড়াটি আস্ত থাকতো না ।গোটা বাঁশের বেড়া  হই হই করে তুলে নেয়া হত। এ ছাড়া ফল, সবজি, মুরগি,হাঁস সবই চুরি হত ।    তারপর এল খাওয়াদাওয়া  ।সে কি আনন্দ।নিজের হাতে রান্না করে খাওয়া।রান্নাবাটি খেলা । দাদারা ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলত । আমাদের এর ওর কাছ থেকে চেয়ে চিনতে  সব্জি ,ডিম ,চাল  যোগাড় করা । কখন কখন মুরগির মাংস হত ।নিষিদ্ধ  মাংস । তারপর আবার কায়স্থ বামুনে মাখামাখি । ঠাকুমাকে পুরো ব্যাপারটাই চেপে দেয়া হত ।   মেয়ে বলে খাওয়ার পর বাড়ি ফেরা।রাতে থাকা চলবে না । ছেলেদের অবশ্য সে সব নেই।তাই দাদারা সারারাত ভেলাঘরে থাকত। আমাদের মন খারাপ হত ।ইচ্ছে করত সারারাত বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে কাটাই । তা আর কোথায় । তাই গুটি গুটি পায়ে ঘরে ফেরা ।  পরদিন সক্কাল বেলা চান করেই দৌড় ভেলা ঘরে ।এবার এতদিনে তৈরি করা প্রিয় ঘরটি জ্বালিয়ে দিতে হবে, তাই নিয়ম। ভোরবেলা সূর্য উঠছে আর দিকে দিকে মেজি , ভেলা ঘর পুড়ছে ।আগুন আর সূর্যদেব চোখাচোখি। পৌষের প্রচণ্ড শীতের সকালে কি আরাম !  ভেলাঘরের চারপাশ ঘিরে মা দের রাতের তৈরী পিঠে খাওয়া । মেজি ঘর জ্বালাবার সময় তিলপিঠে পান-তাম্বুল ও পয়সা দেয়া হত । আগুনকে  ঘিরে  চলত পিঠে খাওয়ার ধুম । গ্রামে এই মেজির পোড়া ছাই ক্ষেতের মাটিতে ছড়িয়ে দেয়া হত। বিশ্বাস তাতে মাটি উর্বর হয়।  আগামি বছরের আরও ভাল ফসলের আশায় ।কারন বিহু আসলে ফসল কাটা ,পুর্ন ভাণ্ডারের  উৎসব। ভোগালি বিহু ভোগের নতুন চালের উৎসব ।যেমন বাংলায় পৌষ  সংক্রান্তি  । মাটির গান। হারভেস্টিং সং । আর আগুন জ্বালিয়ে আসলে অগ্নি উপাসনা করা হয় । তাকে খুশি রাখা । সে আবার অন্য গল্প । আর্য্য প্রভুদের কথা । তারপর সংক্রান্তির দিন সারাদিন হইহুল্লোড় খাওয়া দাওয়া আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে পিঠে পাঠানো বা গিয়ে গিয়ে পিঠে খাওয়া ।যেহেতু তিল সংক্রান্তি তাই তিল পিঠের খুব চল ছিল আসামে এ ছাড়া ছিল ঘিলাপিঠা ,ভাতপিঠা ,খোলাপিঠা ,বরপিঠা।বরাচালের গুড়ি বানিয়ে ভাজা হত ,তাকে বলা হত 'হুরুম' । এ ছাড়া বিরনির চাল। পশ্চিমবঙ্গে এই চাল  দেখিনি । বাশের চোঙ্গের ভেতর অল্প জল দিয়ে উনুনে পোড়ান হত। তাকে বলা হত চুঙ্গাপিঠা ,  খুব জমাট বাধা  দই দিয়ে খাওয়ার রেয়াজ সেটা । এ ছড়া অসমীয়া সমাজে নতুন চালের পিঠা ,তিলের পিঠা, নতুন আলু খাওয়া হয়। আলু না খেলে নাকি পরের জন্মে শুয়োর হয়ে জন্মাতে হবে তেমন বিশ্বাসও আছে গ্রামে গঞ্জে ,মানে এতটাই আলুর মাহাত্ম্য । কারন নতুন আলুতো তখন ভরপুর ।মাছ ,মাংস ,বিশেষত চিতল মাছ খাওয়া হত । তেমনি আসামে থাকা বাঙ্গালীরা বিহু যেমন পালন করতেন পরেরদিন পৌষ  সংক্রান্তি পালিত হত মহা ধুমধাম করে ।বাঙ্গালিদের বাড়িতে হত পাটিসাপটা ,দুধপুলি ,চন্দ্রপুলি ,ছোলারপিঠে ,মুগসলই, জামপিঠে,গোকুল পিঠে ,এলঝেল  আর কত !!দুটো অনুষ্ঠানই গা জড়াজড়ি করে চলত । উৎসবমুখর হয়ে উঠত পরিবেশ ।ভালবাসার আবহটি ও গড়ে উঠত, মজবুত হত  সম্পর্ক । ভোগালি বিহু ও পৌষ সংক্রান্তি ,বড় আদরের ও অপেক্ষার উৎসব । কৃষকের কোলভরা ,মনভরা উৎসব ।

Friday, 6 January 2012

আলাপ ~~~~

 
                                                                 
আলজিভে বানিজ্য , জিভে কবিতা
ঠোঁটে ভালবাসা ।
লক্ষ্মী কবিতার গোঁড়ায় বিষ ,
মনের ভেতর গর গর অন্য
এক রেয়াজ, সহজ সরগম
অনেকদূর ,আলজিভ জিভ
গড়িয়ে ঠোঁটে নামুক অমৃত
রাগিণী জলাধার ।

লোকাল লেডিস কামরা~~~~~~~~~~~~~~~


ঐ আসছে ক্যাটারপিলার !কোমর দোলাতে দোলাতে । রোজদিন  রিয়া টেনশন ফ্রি  হয় এ ভাবে !! এরপর তো যুদ্ধ শুরু । ঐ এল । ওঠা গেলো  । মহিলা কামরা । একটি  ছোটখাটো প্রমিলা রাজ্য বল্লেও কম বলা হয় ।  আপাত শ্রেণি বিভাজন আছে কিন্তু আধিপত্য উচ্চবর্গের হাতে নেই। স্কুলের দিদিমনিরা সংখ্যায় বেশী। নরেন্দ্রপুর ,গড়িয়া , থেকে বনগাঁ  , কৃষ্ণনগর   ,ডানকুনি । কোথায় নয়? উত্তর থেকে দক্ষিন , পুব থেকে পশ্চিম ;  মেন থকে কর্ড সব লাইন । কখনো গঙ্গা পেরিয়ে ,কখন  ভ্যান  রিক্সায় , ট্রেনের আগু পিছু সব কিছু চেপে হাঁপাতে হাঁপাতে  ট্রেন ধরা ।  তবুও  যথেষ্ট সেজেগুজে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসেন । পোশাক নিয়ে অনেক হাল্লা চিল্লা পেরোতে হয়েছে তাদের । কেউ নড়াতে পারেনি । দিদিমনিদের দেবী ভাবের  ধাচা  থেকে বেশ ভালই  মুক্ত হতে পেরেছেন নতুন প্রজন্ম । বসে কেউ একটু ঝিমিয়ে নেন । সকালে ঘুম থেকে ওঠা অব্দি ঘোড় দৌড়  । রান্নার লোক থাকলেও বাচ্চার টিফিন , নিজের টিফিন ,  বরের টিফিন । এখন খাওয়া তখন খাওয়া  বন্দোবস্ত করা ।দিনের সব কিছুর ব্যবস্থাপনা  করে রেখে আসা । ফিরতে ফিরতে তো সেই সন্ধ্যে । সুতরাং একটু খানি চোখ বোজা । কেউ কেউ আবার বই খুলে বসেন । এই তো দিনে একটুখানি নিজের মত করে সময় পাওয়া । কখন দেড় , কখন দুই ঘণ্টার যাত্রা । কেউ কেউ আবার এই সময় টুকু নিজের খাতা খুলে বসেন । কোথায়  কবে কি করলেন । বর কবার বিদেশ গেলেন  ,ছেলে কত টাকা রোজগার করে , সে বছর ক টাকা বর ইনকামট্যাক্স দিয়েছে ।  তা নিয়ে আবার মজাও কম হত না । এই রকম লোকদের খচাতে জুড়ি ছিলনা সুমির ।  'তারপর কি হল বলুন না  সীমাদি । ছেলের জন্য পাত্রি পেলেন , কোটিপতি ,ইঞ্জিনিয়ার ?' তিনি অতি উৎসাহে বলতে লাগলেন বর এবং ছেলের খতিয়ান । আর তারপর পিটপিট করে হাসতে লাগলো  আশপাশ।
তা সে দিদিমনিদের ওপর আবার অনেকে মহা খচা । 'এই এসেছেন ~ এখনি শুরু হবে কোথায় নামবেন , কোথায় নামবেন ।' দোষ নেই এতক্ষনের যাত্রা বসতে তো হবেই ।  কোন কোন যাত্রি সহৃদয় । উদ্যোগী হয়ে  বল্লেন কোথায় নামবেন । কেঊ কেঊ  কিছু বললেন না । কিন্তু টুক করে পরের স্টেশনে নেমে গেলেন ।   সিটটি হয়ত পাওয়া গেল না ।
সাড়ে দশটার ট্রেনে থাকে সবজি মাসিরা । ভোর চারটের উঠে বেরোতে হয় । তারপর শেয়ালদায় সবজি বিক্রি ।সব সময় কিছু বলার জন্য  ব্যস্ত ।  হয়ত সারা দিনের ক্লান্তি ।  তবে প্রায় ই সবার সঙ্গে উচ্চকিত । দিদিমনিরা জায়গা পাননি দাঁড়িয়ে আছেন । চুল উড়ে যদি কোন কারনে গায়ে লাগে তাহলে খুব রাগ হয় মাসিদের । এ নিয়ে বেশি কথা বলতে গেলে বলে বসল হয়ত' জানি জানি ব্যাগ দুলিয়ে কোথায় যাও ! 'সব্বনাশ ! তারপর আর মুখ খোলে কেউ ? ভদ্রলোকের  নিকুচি করেছে । পুরো আকুপাংচার ভদ্রতার মানদণ্ড। জেনারেল কামরায় থাকলে  দেখা যাবে  সঙ্গে  একটি  প্রেমিকপ্রবর  বর নয়, আশনাই -এর রকম সকম দেখলেই  বোঝা যায় ।  চোখে মুখে লজ্জা । এরপর উঠবে  সকালের খাবার । সেই কোন রাতে  উঠে কোনোমতে দৌড়ে বেরিয়ে আসা । কারো  কারোকে  আবার এর মধ্যে রান্না বান্না করে রেখে আসতে হয় । মুখে চা ছাড়া কোন কিছু দিয়ে আসা হয় না । তাই খাওয়া । পরোটা ,আলুর দম , ডিমের ঝোল কখনো কখনো । সঙ্গে জল ও নিয়ে আসে ভেন্ডার ছেলেটি । শেষে মিষ্টি । খুব যত্ন করে খাওয়ায় ছেলেটি । সবাই মিলে হই হই  ,যেন যৌথ পরিবার খেতে বসেছে । এটাই হয়ত সারাদিনের পুষ্টিকর খাওয়া ! তারপর সারা পরিবার কে খাইয়ে কি আর জোটে । বাড়ি পৌঁছেই তো ঘোড় দৌড় শুরু হবে । ফুলওয়ালি  ও ব্লাউস মাসিদের  আবার কাজে ও বসতে হয় বাড়ি গিয়ে ।  দশটি  টি  ব্লাউসে বোতাম লাগালে এক টাকা । দশটি মালা গাথলে এক টাকা । তখন বাড়ির কন্যা সন্তানটিকে রান্নার হাল ধরতে হয় । তাই কখন কখন  ট্রেনে বসেই হাত চলতে থাকে ।বিকেলের ট্রেনে থাকে শেয়ালদার দিদিরা । দাঁড়াতে হবে স্টেশনের বাইরে খদ্দের ধরার জন্যে । ভেতরে গেলে পুলিশের ঝামেলা । তাদের মুখে সব সময় একটি সংকুচিত ভাব । সিঁথিতে এক ঢাল সিদুর । নিপুন শাঁখা পলা । মলিন একটি  ব্যাগ । কথা খুব কম বলে । ঝামেলা হলে অন্যকথা । তখন রণরঙ্গিণী ।  আর আছেন সুনিপুন নারী সাজে  মানুষ । দঙ্গল বেধে ওঠেন । চুন থেকে পান খসার দরকার নেই ,এমনিতেইরাখে হরি মারে কে । ভয়ে কাঁটা । বসার জায়গা দিয়ে নিশ্চিন্ত ।

অপূর্ব মানুষের অবিরাম চলা । মনে হয় সমস্ত সমাজটা যেন এক কামরায় ঢুকে গেছে ।  শ্রেণিহীন রেলের কামরা । ছোট্ট একটি বাংলা । ভারতবর্ষ ছোট হয়ে জায়গা খুঁজে নিয়েছে ।
                                                ~~~~