প্রতিমাসের দু নম্বর রবিবারে হাবু মাস কাবারি বাজার দিয়ে যায়। জিরে পোস্ত হলুদ শস্যে সার্ফ টুথপেষ্ট ইত্যাদি । হাবুর চেহারা খুব লম্বা চওড়া ।প্রায় ৬ ফুট । স্বাস্থ্য খানা ও মন্দ নয়। হাত পা গুলো টানটান। ওমন ৬ ফুট ছিপে ছিপে চেহারা যে কোথা থেকে পেল! চৌকোনা মুখ—চাপা রং ,দাতে একটু মিশি মাখানো। বোধহয় চাপা কলের জল ব্যবহার করে। কিন্তু চোখ দুটোর মধ্যে একটা মায়াবী ছায়া খেলা করে । হাউ হাউ করে কথা বলে। যেন থামতে জানে না । বুকের ভেতরের দরজা বন্ধ নয় কপাট খোলা। দশ বছর বয়েস থেকে বাড়ীর কাছে মুদির দোকানে ফাই ফরমাস খাটে । ওর বাবা ই বন্দোবস্ত করেছিলেন ।
হাবুর বাবা- সুকুমার সাহা । দর্জির কাজ করেন । দুই মেয়ে এক ছেলে । কোন রকমে সাংসার চলছে । উদ্বাস্তু হয়ে এই পাড়ায় এসে উঠেছিলেন । এই পাড়ায় সবাই ওপার বাংলার । আয় তেমন হয় না। সুতরাং ছেলেকে দিয়ে রোজগারের চেষ্টা। হাবু কিন্তু সকলের চোখের মনি । ফরমাশ করার আগে ই ছোটে। চালাকি করে না । ফাঁকি মেরে বাজিমাত করার কোন চেষ্টা নেই। কেবল পড়াশোনা তা সে ভাবে হল না। দু বার মাধ্যমিক দিয়েছিল পাশ করতে পারেনি ।
গোবিন্দর দোকানই তার ঠিকানা । দোকান টা মোটামুটি সে ই সামলায় । সকাল সাত টা থেকে দোকানে থাকে।দুপুরে একবার দোকান বন্ধ হয় । আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার সকলের বাড়ীতে গিয়ে জিনিসপত্র পৌছে দেয়া । হাবুর বয়েস এখন পঁচিশ । খুব ইচ্ছে একটা দোকান খোলার। যাদের বাড়ীতে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাফ প্যান্ট পরে জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে যায় সকলকেই এই ইচ্ছের কথা প্রকাশ করে ।
দেশবন্ধুনগরের দরজিপাড়ার ছোট্ট একফালি গলির মধ্যে দু কামরার ঘর। বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন। মা নেই। দুই দিদি ।একজনের বিয়ে হয়েছে কিন্তু ফেরত। দু সন্তান সমেত। আর এক দিদি বোঝে কম। চিকিৎসা হয়নি ।তাই শৌখিন রিটার্ডেড নাম লাগেনি । এখনও কুচি দেয়া জামা পরে। তিরিশ বছর বয়েশ। বড়দি আয়া সেন্টারে নাম লিখিয়েছে ।বার ঘণ্টা কাজ করলে একশ টাকা পায় ।মাঝে মাঝে কাজ থাকে না ।তখন দিনে শূন্য । no work no pay.বিশ্বায়নের যুগ।আট ঘণ্টার কাজ স্বপ্ন? নিশ্চিন্দি চাকরি –সম্মান ।সব ই কেমন অচেনা লাগে ।এখনকার প্রজন্ম বার চৌদ্দ আঠার কুড়ি ঘণ্টা কাজ করে । তবুও নিশ্চিন্ত নয় ।এই গেল এই গেল ভাব। নিশ্চিন্দিপুরে নয় আশঙ্কাপুরে বাস।
যাকগে,সবাই একটু একটু সাহায্য করে পয়লা বৈশাখে দোকানের উদ্বোধন হল। ঘরের লাগোয়া বাড়ীর সামনের এক ফালি খলি জায়গায় । ইটের ওপরে ইট চাপিয়ে কোন মতে এক খাবলা সিমেন্ট দিয়ে বেশি বালি মিশিয়ে একটি ঘর খাড়া করা হল। ঝকঝকে কাঁচের ঘেরাটোপ নয় ।উরদিপরা বকলেস লাগান ছবি সহ পরিচয় পত্র নেই।কনরকমে আট ফুট বাই পাঁচ ঘরের ঘেরা টোপ।
তখন পঁচানব্বই ছিয়ানব্বই সাল।নতুন টাউনশিপ রাজারহাট উদ্বোধন হবে। তোড়জোড় চলছে। দিকে দিকে বারতা রটে যাচ্ছে ক্রমে। ভি আই পি রোডের সমান্তরাল বেশ বড় পাকা রাস্তা সটান টাকি রোড এ গিয়ে উঠেছে। চোখের আড়ালে থাকা দুয়োরানী রাস্তাটির কদর বেড়ে গেল। দৃষ্টির আড়ালে থাকা অঞ্চল নতুন কলকাতা হবে। রাতারাতি বেড়ে গেল জমির দাম। যাদের একটু বেশি জমি ছিল চার কাঠা পাঁচ কাঠা বা তার বেশি তারা রাতারাতি রাজা হয়ে গেল। প্রমোটারের বদান্যতায় পেটে বিদ্যে না থাকলেও জমির দৌলতে বাড়ীতে আধুনিক গেজেট বসল ।-চুন সুরকির ব্যবসা হল। পালে পালে ওনারশিপ ফ্ল্যাট গড়ে উঠলো। গুটি গুটি পরিযায়ী পাখির মত লোক আসতে লাগল । পাড়ার লোকেরাই যেন বাইরের লোক হয়ে উঠল । সাতচল্লিশ সালের পর দলে দলে ছিন্নমুল মানুষের ঢল নেমে জায়গাটি বর্ধিষ্ণু হয়েছিল ।এপারের বাগুইদের সঙ্গে ওপারের সাহাদের সুন্দর সহাবস্থান তৈরি হল।এখন আবার আগরয়াল ,ঝুনঝুনওয়ালাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। সাদরে গ্রহন করল তারা। যেন পাড়ার অতিথি।
--‘যা চাই বলবেন দিদি ‘।হাবুর উচ্ছাস ভরা মুখ।
।
হাবুর দোকান বেশ ভালই চলছিল।তাক ভরতি হল মশলাপাতি বিস্কুট সাবান তেল সস। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে আবার সেক্টর ফাইভ এর বিশাল অঙ্কের চাকুরিয়ানরাও রয়েছেন। সুতরাং তাদের জন্য কিছু বিশেষ বিশেষ জিনিস রাখতে হয়। ঝুলতে লাগল রেডি আদাবাটা রশুনবাটা আচার কর্নফ্লেক্স চিপস বিভিন্ন রকম শ্যাম্পুর স্যসে আরও কত কি বাহারে জিনিস। আমরা সচেতন ভাবে ওর দোকান থেকেই জিনিস কিনতাম।
আমরা যারা ওকে একটু বিশেষ স্নেহের চোখে দেখি দোকান খোলার দিন গেলাম। মনে হল এ পোড়া জীবনে যা হোক একটা বেশ কিছু করা গেল। খুব এক খানা আত্মতৃপ্তি হল। হাবু আগে যে দোকানে কাজ করত সেটাকে আমরা বুড়োর দোকান বলতাম। সেখানে আমরা আর যাচ্ছি না। হাবুর দোকান থেকেই সব জিনিস কেনা হয়। বেশ চলছিল। হাবু বিয়ে করেছে। দু কামরার ঘর তিন কামরা হয়েছে। একটি বাচ্চা ও হয়েছে। সে ও খুশ আমরা ও খুশ।
কিন্তু জীবন কি সবার জন্যে সোজা পথে হাটে? হাবুদের বেলায় নয় বোধহয়। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল ফিগবাজার খোলা হবে—আশিহাজার স্কোয়ারফিট। দুনিয়াদারির সব কিছু এক ছাদের তলায়। খাওয়াদাওয়া, গয়নাগাটি, কাপড় চোপড়, বাসন কোসন, হরেক মাল। ঠাণ্ডা ঘরের কাঁচের দরজার ভেতরে দোকান থুড়ি রিটেল স্টোর খোলার প্রথম দিন কাছাকাছি গ্রাম থেকে আসা মানুষ এমন ভাবে হামলে পড়ল যে কাচের দরজা ভেঙ্গে চৌচির ! আশে পাশের মানুষগুলো ত এমন বৈভব দেখেনি! একসঙ্গে এত জিনিস কি এরা কখন দেখেছে? হারেকমাল অনেকদাম।
হাবুর দোকানে যারা হাজার বারশ টাকার বাজার করতেন তারা হারেকমাল মনোহারিণী দোকানের ঠাণ্ডা ঘরে ছুটলেন।বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ধোপ দুরস্ত হয়ে পারফিউম সহযোগে পরিবার সহ ভ্রমন। আহা কি সুখ! গরমের বালাই নেই।ঝলমলে দোকানে ঢোকার মুখে উর্দিপরা দরওয়ানের মুখে ‘ওয়েলকাম’।যেন মধু বর্ষন হল। একেবারে রাতের খাওয়া সেরে ফেরা।
মুখ শুকাতে শুরু করল বাবুর। প্রথম কিছুদিন ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। শুধু দেখল ওর আয় ক্রমশ কমছে। আমরা কজন বাঙালি জাতীয়তাবোধে ও হাবুর প্রতি মায়ায় ওর দোকানের ভরসা তে রইলাম। বা ও আমাদের ভরসায় রইল।
তারপর এল মিশাল মার্কেট –কালিকট বাজার- মিত্রা বাজার- মিটিমিটি সেন্টার । হাবু প্রমাদ গুনল। অথ কিম? প্রতিমাসে বাজার পৌছে দিতে এসে হাত পা ছড়িয়ে বসে আশঙ্কার কথা জানায়। আমরা আতঙ্কিত হই।
--‘কি রে সংসার চলছে ত ?দোকান ঠিক মতো চালাতে পারছিস তো ?দোকানের মাল পত্র আনার মত টাকা আছে তো?’ হু হা জবাব তার। চোখের তলায় কালি। বাজার জগত কে রোখার ক্ষমতা ওর নেই।
বেশ কিছুদিন হল হাবু আর মালপত্র দিয়ে যাচ্ছে না। রোজ দিন ই হাবুর কথা ভাবি। কোন খবর পাচ্ছি না ওর।অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কত আর মনে থাকে ?কিছুদিন পর শুনলাম হাবুর দোকান যা ভেবেছিলাম তাই, বিক্রি হয়ে গেল। দোকান কিনল দানী সিং –বিহারের লোক। খুব অমায়িক। রোজ সকালে চুনসুরকি বাড়ীর লাগোয়া নবনির্মিত শিব মন্দির পুজো দেয়। লালটিকা, চন্দন , শোভিত কপালে দোকান খোলে। দেখা হলেই আকর্ণ হাসি।–‘দিদি হামার দোকানে আসবেন।‘আসব তো বটেই ,দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে বলি।
হাবু এখন রিক্সা চালায় ।এ রকম আধা মফস্বলি পাড়ায় এখনও মারসেডিস রিক্সা কে হারাতে পারেনি।তাই রক্ষে। হাবুর জীবন চলবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। একবার উঠে দাঁড়াবে , হামাগুড়ি দেবে, তারপর মুখ থুবড়ে পরবে।
~~~~~~~~্্্্্্্্্~~~~~~~~