Monday, 29 August 2011

হাবুর হা ঘর


                               
প্রতিমাসের দু নম্বর রবিবারে হাবু মাস কাবারি  বাজার দিয়ে যায়। জিরে পোস্ত হলুদ শস্যে সার্ফ টুথপেষ্ট ইত্যাদি । হাবুর চেহারা খুব লম্বা চওড়া ।প্রায় ৬ ফুট । স্বাস্থ্য খানা ও মন্দ নয়।  হাত পা গুলো টানটান ওমন ৬ ফুট  ছিপে ছিপে  চেহারা যে কোথা থেকে পেল! চৌকোনা  মুখ—চাপা রং ,দাতে একটু মিশি মাখানো।  বোধহয় চাপা কলের জল ব্যবহার করে। কিন্তু চোখ দুটোর মধ্যে একটা মায়াবী ছায়া খেলা করে । হাউ হাউ করে কথা বলে। যেন থামতে  জানে না । বুকের ভেতরের দরজা বন্ধ নয় কপাট  খোলা। দশ বছর  বয়েস থেকে বাড়ীর কাছে মুদির দোকানে ফাই ফরমাস খাটে । ওর বাবা ই বন্দোবস্ত করেছিলেন ।
হাবুর বাবা- সুকুমার সাহা । দর্জির কাজ করেন । দুই মেয়ে এক ছেলে । কোন রকমে সাংসার চলছে । উদ্বাস্তু হয়ে এই পাড়ায় এসে উঠেছিলেন । এই পাড়ায় সবাই ওপার  বাংলার । আয় তেমন হয় নাসুতরাং ছেলেকে দিয়ে রোজগারের চেষ্টা। হাবু কিন্তু সকলের চোখের মনি ।  ফরমাশ করার আগে ই ছোটে। চালাকি করে না ।  ফাঁকি মেরে বাজিমাত করার কোন চেষ্টা নেই। কেবল পড়াশোনা তা সে ভাবে হল না। দু বার মাধ্যমিক দিয়েছিল পাশ করতে পারেনি ।
গোবিন্দর দোকানই তার ঠিকানা । দোকান টা মোটামুটি সে ই সামলায় । সকাল সাত টা থেকে দোকানে থাকে।দুপুরে একবার দোকান বন্ধ হয় ।  আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার সকলের বাড়ীতে গিয়ে জিনিসপত্র পৌছে দেয়া । হাবুর বয়েস এখন পঁচিশ । খুব ইচ্ছে একটা দোকান খোলার।  যাদের বাড়ীতে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাফ প্যান্ট পরে জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে যায়  সকলকেই এই ইচ্ছের কথা প্রকাশ করে ।
দেশবন্ধুনগরের দরজিপাড়ার ছোট্ট একফালি গলির মধ্যে  দু কামরার ঘর বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন। মা নেই। দুই দিদি ।একজনের বিয়ে হয়েছে কিন্তু ফেরত। দু সন্তান সমেত। আর এক দিদি বোঝে কম। চিকিৎসা হয়নি ।তাই শৌখিন রিটার্ডেড নাম লাগেনি   এখনও কুচি দেয়া জামা পরে। তিরিশ বছর বয়েশ। বড়দি আয়া সেন্টারে নাম লিখিয়েছে ।বার ঘণ্টা কাজ করলে একশ টাকা  পায় ।মাঝে মাঝে কাজ থাকে না ।তখন দিনে শূন্য । no work no pay.বিশ্বায়নের যুগ।আট ঘণ্টার কাজ স্বপ্ন? নিশ্চিন্দি চাকরি –সম্মান ।সব ই কেমন অচেনা লাগে ।এখনকার প্রজন্ম বার চৌদ্দ আঠার কুড়ি ঘণ্টা কাজ করে । তবুও নিশ্চিন্ত নয় ।এই গেল এই গেল ভাব। নিশ্চিন্দিপুরে নয় আশঙ্কাপুরে বাস।
যাকগে,সবাই একটু একটু সাহায্য করে পয়লা বৈশাখে দোকানের উদ্বোধন হল। ঘরের লাগোয়া বাড়ীর সামনের এক ফালি খলি জায়গায় । ইটের ওপরে ইট চাপিয়ে কোন মতে এক খাবলা সিমেন্ট দিয়ে বেশি বালি মিশিয়ে একটি ঘর খাড়া করা হল।  ঝকঝকে কাঁচের ঘেরাটোপ নয় ।উরদিপরা বকলেস লাগান ছবি সহ পরিচয় পত্র নেই।কনরকমে আট ফুট বাই পাঁচ ঘরের ঘেরা টোপ।
তখন পঁচানব্বই ছিয়ানব্বই সাল।নতুন টাউনশিপ রাজারহাট  উদ্বোধন হবে তোড়জোড় চলছে। দিকে দিকে বারতা রটে যাচ্ছে ক্রমে। ভি আই পি রোডের সমান্তরাল বেশ বড় পাকা রাস্তা  সটান টাকি রোড এ গিয়ে উঠেছে চোখের আড়ালে থাকা দুয়োরানী রাস্তাটির কদর বেড়ে গেল। দৃষ্টির আড়ালে থাকা  অঞ্চল নতুন কলকাতা হবে। রাতারাতি বেড়ে গেল জমির দাম। যাদের একটু বেশি জমি ছিল চার কাঠা পাঁচ কাঠা বা তার বেশি তারা রাতারাতি রাজা হয়ে গেলপ্রমোটারের বদান্যতায় পেটে বিদ্যে না থাকলেও জমির দৌলতে বাড়ীতে আধুনিক গেজেট বসল ।-চুন সুরকির ব্যবসা হল।  পালে পালে ওনারশিপ ফ্ল্যাট গড়ে উঠলো গুটি গুটি পরিযায়ী পাখির মত লোক আসতে লাগল । পাড়ার লোকেরাই যেন বাইরের লোক হয়ে উঠল । সাতচল্লিশ সালের পর দলে দলে ছিন্নমুল মানুষের ঢল নেমে জায়গাটি বর্ধিষ্ণু হয়েছিল ।এপারের বাগুইদের সঙ্গে ওপারের সাহাদের সুন্দর সহাবস্থান তৈরি হল।এখন আবার আগরয়াল ,ঝুনঝুনওয়ালাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। সাদরে গ্রহন করল তারা। যেন পাড়ার অতিথি।
--‘যা চাই বলবেন দিদি ‘হাবুর উচ্ছাস ভরা মুখ।
হাবুর দোকান বেশ ভালই চলছিল।তাক ভরতি হল  মশলাপাতি বিস্কুট সাবান তেল সস পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে আবার সেক্টর ফাইভ এর বিশাল অঙ্কের চাকুরিয়ানরাও রয়েছেন। সুতরাং তাদের জন্য কিছু বিশেষ বিশেষ জিনিস রাখতে হয়। ঝুলতে লাগল রেডি  আদাবাটা রশুনবাটা আচার  কর্নফ্লেক্স চিপস বিভিন্ন রকম শ্যাম্পুর স্যসে আরও কত কি বাহারে জিনিস আমরা সচেতন ভাবে  ওর দোকান থেকেই জিনিস কিনতাম।
আমরা যারা ওকে একটু বিশেষ স্নেহের চোখে দেখি দোকান খোলার দিন গেলাম। মনে হল এ পোড়া জীবনে যা হোক একটা বেশ কিছু করা গেল। খুব এক খানা আত্মতৃপ্তি হল   হাবু আগে যে দোকানে কাজ করত সেটাকে আমরা বুড়োর দোকান বলতাম। সেখানে আমরা আর যাচ্ছি না  হাবুর দোকান থেকেই সব জিনিস কেনা হয়। বেশ চলছিল। হাবু বিয়ে করেছে। দু কামরার ঘর তিন কামরা হয়েছে। একটি বাচ্চা ও হয়েছে।  সে ও খুশ আমরা ও খুশ।
কিন্তু জীবন কি সবার জন্যে সোজা পথে হাটে? হাবুদের বেলায় নয় বোধহয়। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল ফিগবাজার  খোলা হবে—আশিহাজার স্কোয়ারফিট দুনিয়াদারির সব কিছু এক ছাদের তলায় খাওয়াদাওয়া, গয়নাগাটি, কাপড় চোপড়,  বাসন কোসন, হরেক মাল। ঠাণ্ডা ঘরের কাঁচের দরজার ভেতরে দোকান থুড়ি রিটেল  স্টোর খোলার প্রথম দিন কাছাকাছি গ্রাম থেকে আসা মানুষ এমন  ভাবে হামলে পড়ল যে কাচের দরজা ভেঙ্গে চৌচির ! আশে পাশের মানুষগুলো ত এমন বৈভব দেখেনি! একসঙ্গে এত জিনিস কি এরা কখন দেখেছে? হারেকমাল  অনেকদাম।
হাবুর দোকানে যারা হাজার বারশ টাকার বাজার করতেন তারা হারেকমাল মনোহারিণী দোকানের ঠাণ্ডা ঘরে ছুটলেন।বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ধোপ দুরস্ত হয়ে পারফিউম সহযোগে পরিবার সহ  ভ্রমন। আহা কি সুখ! গরমের বালাই নেই।ঝলমলে দোকানে ঢোকার মুখে উর্দিপরা দরওয়ানের মুখে ‘ওয়েলকাম’যেন মধু বর্ষন হল।  একেবারে রাতের খাওয়া সেরে ফেরা।
মুখ শুকাতে শুরু করল বাবুর। প্রথম কিছুদিন ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। শুধু দেখল ওর আয় ক্রমশ কমছে। আমরা কজন বাঙালি জাতীয়তাবোধে ও হাবুর প্রতি মায়ায়  ওর দোকানের ভরসা  তে রইলাম। বা ও আমাদের ভরসায় রইল।   
তারপর এল মিশাল মার্কেট –কালিকট বাজার- মিত্রা বাজার- মিটিমিটি সেন্টার । হাবু প্রমাদ গুনল। অথ কিম? প্রতিমাসে বাজার পৌছে দিতে এসে হাত পা ছড়িয়ে বসে আশঙ্কার কথা জানায়। আমরা আতঙ্কিত হই।
--‘কি রে সংসার চলছে ত ?দোকান ঠিক মতো চালাতে পারছিস তো ?দোকানের মাল পত্র আনার মত টাকা আছে তো?’ হু হা জবাব তার। চোখের তলায় কালি। বাজার জগত কে রোখার ক্ষমতা ওর নেই।
বেশ কিছুদিন হল হাবু আর মালপত্র দিয়ে যাচ্ছে না। রোজ দিন ই হাবুর কথা ভাবি। কোন খবর পাচ্ছি না ওর।অনেক ব্যস্ততার মধ্যে  কত আর মনে থাকে ?কিছুদিন পর শুনলাম হাবুর দোকান যা ভেবেছিলাম তাই,  বিক্রি হয়ে গেল। দোকান কিনল দানী সিং –বিহারের লোক।  খুব অমায়িক  রোজ সকালে  চুনসুরকি বাড়ীর লাগোয়া নবনির্মিত শিব মন্দির পুজো দেয়। লালটিকা,  চন্দন , শোভিত কপালে  দোকান খোলেদেখা হলেই আকর্ণ হাসি।–‘দিদি হামার দোকানে আসবেন।‘আসব তো বটেই ,দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে বলি।
হাবু এখন রিক্সা চালায় ।এ রকম আধা মফস্বলি পাড়ায় এখনও মারসেডিস রিক্সা কে হারাতে পারেনি।তাই রক্ষে। হাবুর জীবন চলবে  খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েএকবার উঠে  দাঁড়াবে , হামাগুড়ি দেবে, তারপর মুখ থুবড়ে পরবে।
                      ~~~~~~~~্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌~~~~~~~~

এখন তখন


মি-----তিন’,দূর থেকে দূরভাষ শুনতে পেল মিতিন।পলার গলা ।সেরকমই সুরেলা ও ন্যাকা ন্যাকা।অনেকদিন আগের পাহাড়ঘেরা ,গাছ গাছালি পরিবেষ্টিত ইউনিভার্সিটি –র গাছ পালার ফাঁক দিয়ে যেন শব্দটা কানে এসে পৌছল।মনে হছিল সে আর গাড়িয়াহাটের একরাশ পথ-পরিক্রমার ক্লান্তি ও জনাকীর্ণ হাঁসফাঁসের মধ্যে দাড়িয়ে নেই।দাড়িম্ব বকুলের মায়াঝরা আবিলতার বাতাস ওর কানে ও চুলে হাত বুলিয়ে গেল।
--‘কি রে অমন উপচে উপচে কোথাই চলেছিস?’
                                            ক –তদিন পর ,বোধহয় আট বৎসর –না –মাঝে একবার   একবার পলকের জন্য দেখা হয়েছিল দুই প্রিয় সখির ।দমদম এয়ারপোর্ট এমিতিন গিয়েছিল ছোট বোন কে তুলেদিতে আর পলা যাচ্ছিল বম্বে ।পড়ার দিনগুলো প্রায় পনের  বছর আগে ,তারপর পলা নিউইয়র্ক আর মিতিন কলকাতার ভাঙ্গা দেয়ালে ।ভাঙ্গাচোরা যখন চূড়ান্ত সেই সময় ই পলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আর তারপর এই ।
--‘তা চেহারা ছবিখানা ত সেরকম ই রেখেছ ।তেমনি ই আছ ,ঝকঝক করছ।তা লেডি প্রমিথিউসএর খবর কি?’—মাথা থেকে পা পর্যন্ত জরিপ করে  এই প্রশ্ন।
-‘লেডি প্রমেথিউস নই রে ,শৃঙ্খলিত ,completely bounded by the chain.
--ও তাই !!সেটা আবার কি?,-পলার চোখ কপালে!
--,সুখ, সুখ ,সুখের পাখী অনেক দূর নয়হাতের কাছে ,একেবারে হাতের মুঠোয় !’চোখে মুখে কৌতুক মিতিনের দুষ্টুমি ভরা চোখ
--‘ধরতে পেরেছিস তাহলে? পলা ও যথেষ্ট সজীব
-‘বোধহয়!’মিতিনের রহস্যময় জবাব
---‘সেকিরে !তুই তো তাহলে যাদুকর
--‘যাদুকর নই রেপ্রভাত সূর্যের লাল বলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে আর কষ্ট হয় নাঅপলকে তাকিয়ে থাকতে পারিআর তাতে ই সুখকে ধরতে পেরেছিলেকের জলে,গাছের পাতায় ,হিমেল বাতাসে,পরীর ঘুর্ণীতে,মাহারানির পুকুরের তির্যক আলোর খেলায় ,’—কেমন হারিয়ে যাওয়া গলায় বলল মিতিন
--ওখানে সুখ কিনতে পাওয়া যায় বুঝি?’—পলা তার আয়ত চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল
মিতিনের হেঁয়ালি পলাদের আবিষ্ট করে রাখতসেই মিতিন!!এমন বন্ধু  এ জীবনে আর  হল নাযার প্রতি স্নেহ মাখা প্রশ্রয় সকলের ছিলতার মিষ্টি স্বভাবের জন্য
বৈপরীত্য ছিল মিতিনের স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য আর এ জন্য ই ওর চরিত্রে  অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য ছিলযার দীপ্তিতে যে একবার তার কাছে এসেছে,সে আর সরতে পারেনি হই হই করে কবিতা পড়া কোনও নতুন বই বেরোলে চাঁদা তুলে কিনে বিকেলে পাণ্ডুলিপির আসরে সেটা চেঁচিয়ে পড়া পাণ্ডুলিপিহাতে লেখা লিটল ম্যাগাজিন,ছাপাবার পয়সা ছিল না মিতিন কবিতাই লিখত বেশি হঠাৎ একটা ছোটোগল্প লিখে হই চই ফেলে দিয়েছিল।  প্রান ছিল ওর আসল সৌন্দর্য্যআবার কখন ও কখনো গভীর বিষণ্ণতা ওকে আচ্ছন্ন করে রাখত। একবার ওরা সমুদ্রে বেড়াতে গিয়েছিল,তিনদিন মিতিন কোনও কথা বলে নি।দেখি ব্যলকনিতে বসে এক দৃষ্টে সামুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।
-‘কি রে আমরা সবাই চানে যাচ্ছি,যাবি না?’
---‘ তোরা  যা’—বলে হাটতে হাটতে বিচের বেলাভুমির কাছের আকাশ ছোঁয়া গাছ গুলোর মধ্যে  হারিয়ে গেল। কিন্তু সেজন্য আমরা মিতিন কে কখনও ভুল বুঝিনি।অর অদ্ভুত রস নিষিক্ত মণটাকে আমরা ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম।
-‘হেঁয়ালি ছেড়ে বলনা কোথায় আছিস?কি করছিস?’ভীষন বন্ধু হলেও দুজন দুই প্রান্তে থাকায় যোগাযোগ বিছিন্ন।মেয়েদের বন্ধুত্ব পদ্মপাতায় জল।বিয়ের পর নব জন্ম- অন্যের কথায় চলা ,অন্যের কথায় বলা ।যাদেরকে দিনান্তে একবার না দেখলে প্রহর ব্যর্থ হয়ে যেত তারা আজ দিনান্তে মনের কোনে একবার উঁকি  পর্যন্ত দেয় না
-‘এখন শুধু পোস্টমর্টেম হচ্ছি ।পৃথিবীর চোখে চুলচেরা নিক্তিতে মাপা হচ্ছে আমায় কক্ষচ্যুত গ্রহ হিসেবের খাতায় স্থান পাচ্ছে না। দোষী যখন সাব্যস্ত হয়েছি তখন পরীক্ষা দিতে হবে ত পদে পদে ।পাঁচিল দেয়া নেই ত! বেড়াহীন গাছ ত।তাকে ইচ্ছে মত ডাল ছেঁটে দেয়া যায়।এই ত জীবন। দীর্ঘ  সাংলাপ বলে মাথানিচু করল মিতিন। চোখ কি একটু ছলোছলো!
এ আবার কোন মিতিন?-ওর এ কোন স্বর শুনতে পাচ্ছে পলা!সেই উচ্ছ্বাস ভরা  ঝকঝকে সুরটা কোথায় হারিয়ে গেল?সুর –হ্যাঁ সুর –ভীষণ ভালো গান গাইতে পারত মিতিন।বোধহয় গান টা ধরে রাখলেই  একটা কিছু হত। ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর সে পাট আর রাখে নি। মিষ্টি গলা ।যে কোন গান চট করে গলায় তুলে নিতে পারত। কোন গানের কোন জায়গায় সুরে  আঁটকে গেছি ,-চল মিতিনের কাছে ইউনিভার্সিটির কমন রুমে কত গান যে ওর কাছ থেকে তোলা তার আর ইয়ত্তা নেই।আরেক গায়িকা বান্ধবী রীতা ও মিতিনের যৌথ প্রচেষ্টায় কমনরুমে মাঝে মাঝে বসে  যেত জলসা অদ্ভুত যত পরিকল্পনা ওর মাথায় এসে উদয় হত। হঠাৎ একদিন ঠিক হল ব্রহ্মপুত্রের কোলে নৌকায় কবিতা পাঠের আসর বসাতে হবে।যেমন ভাবা তেমন কাজ। অন্তত পক্ষে দুটো করে কবিতা সকলের পড়তে হবে।স্বরচিত হোক বা অন্যের  রচিত  হোক। ওর অনেক চেলা চামুণ্ডা ছিল- যারা ওর এইসব হুজুগের সঙ্গী ও আয়জক।
--‘জানিস তোদের মিতিন এখন আর হুজুগে মাতে না যখন তখন। খটখটে তার স্বভাব ।ছায়াযুদ্ধ চলছে তার মধ্যে ।অন্ধগলিতে রাস্তা খুঁজে মরছে সে ।কন পথ দিয়ে গেলে সে আলোর সরল রেখা সে ছুঁতে পারবে তার চেষ্টা চলছে নিয়ত। আমার কি এমন হওয়ার কথা ছিল রে? ’মনে হল যেন এই কথা গুলো বলার লোক সে পাচ্ছে না।ঝরনার মত ঝর ঝর করে বেরিয়ে আসছে অনেকদিনের  অবরুদ্ধ কথা।শুধু অপেক্ষায় একটি ভগিরথের।তখন ও পর্যন্ত কি জানি না কি এমন ঘটেছে ?শুধু মাঝে মধ্যে আভাস পাচ্ছি খনও আভিব্যক্তিতে কখনও কথার আলটপকা মন্তব্যে ।ওর কথা শুনে ভেতর টা কেমন আকুল হয়ে উঠলো ।যেন রাতচরা পাখী ।মনে হল এই সুরে কখন কথা বলতে শুনিনি ।বড্ডও আভিমান ও  আত্মসম্মানবোধ ছিল ওর।
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না ওকে।মনে হচ্ছিল যেন ক্লান্ত এক পাহাড়ের ধারে এসে দাঁড়িয়েছি আমি।পাশে অনেক নিচুতে খাদ ।আমি একদম খাঁদের পাশে। অপেক্ষা করছি তালিয়ে যাবার জন্য।একট  সীমারেখা এক ধাক্কা দিলে পড়ে যাবদুরে আকাশে কাল মেঘ,ঘনায়মান।জমাটবাধা ।অঝোরে ঝরে পড়বার প্রাক মুহূর্ত।
মিতিন কে আর একা ছাড়তে সাহস পেলাম না।গাড়িয়াহাট থেকে ওর সঙ্গে ওর  সল্টলেকের বাড়ীতে এলাম।সল্টলেকে ওর এক রুমের ফ্ল্যাট। মনে পড়ছিল ওদের বাড়ি ও বাড়ির জমজমাট দুর্গা পুজার কথা।মনের মধ্যে অসম্ভভ এক আকুলতা।ভেতরটা মোচড় দিচ্চে, ওর কথা জানার জন্য ভেতরটা পুড়ছে ।
                                               মেঝেতে বসে ওর মেয়ে একমনে ছবি আঁকছে।  বড় একটি পাহাড় সূর্য উঠছে, সামনে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। একাকী একটি নারী,  শিশুটি হাতে ।
তখনও পুরো আঁকা হয়নি । সবটাই  এলোমেলো। অবুঝ ভাবনার খেলা,অপটু হাতের রং-মশাল । আমি আস্তে আস্তে ওর মেয়ের পিঠে হাত রাখলাম।
                                        ------------------

ঝাঁপতাল নন্দিতা ভট্টাচার্য্য


                                ঝাঁপতাল                           নন্দিতা ভট্টাচার্য্য                       
সীমন্তিনীদিকে প্রথম যেদিন স্কুলে  দেখি তেমন কিছু মনে হয়নি।আস্তে আস্তে বেশ খারাপ ই লাগত। কট কট করে কথা বলে,ঝপ ঝপ করে উত্তর দেয়,হন হন করে হাটেওর হাটা নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে নকল করে দেখাতাম, গোপনে ।
তখন ছিলেন আমাদের সুমিতা দি,যার কথায় আমাদের ওঠা বসা,চলাফেরা।                 
স্কুলের বড়দি অল্প বয়সী ,সুলক্ষণাদি লম্বায় ৫’৬” চেহারা মোটেই বড়দি সুলভ নয়।বেশ সুন্দর টিকলো নাক, ঠোঁটের ওপরে তিল, সিনেমার নায়িকাদের মত দেখতে। প্রধান দলের সমর্থক দলের সমস্ত গুন ই প্রকট। কি ভাবছেন তা বোঝা শিবের অসাধ্যমুহূর্তে গম্ভীর মুখটা  হাসি হাসি করে ফেলেন। ডান হাতের খবর বা হাত জানতে পারে না ।খু-উ-ব গুছিয়ে গত বাধা কথা বলেন। ‘আপনি ,’ ‘আজ্ঞে’ ,’শুনছেন’,।তারপর সাঙ্গাতিক কথা কেমন নির্লিপ্ত মুখ করে বলে ফেলেন।শোনা যায়  রাজনীতির সঙ্গে কোনোদিন ই তেমন যোগাযোগ ছিল না ।।প্রধান শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদেই রাজনীতির আঙ্গিনায়  বাসা বাধা। কিছুদিনের মধ্যেই সুঅভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন। সহজ ভাবে নিদারুন সব নোটিশ পাঠান  হিটলারের ছোটবোন ।সংগ্রাম নয়  বুদ্ধির দক্ষতায় সংগঠনের অনেক উঁচু ধাপে উঠে এসেছেন
স্কুলের স্টাফ রুম একটি ছোটখাটো চলমান এনস্লাইকপেডিয়া২০’*২০’ ঘরে পঁইত্রিশ জন শিক্ষিকার  আবাসস্থল ।মাথার ওপর ফ্যান  অর্ধেকের ওপর বন্ধ থাকে। বর্ষার দিনে ছাদ স্যাঁতস্যাঁতে  হয়ে থাকে।
এ হেন ঘরের আড্ডায় যে কোনও বিষয় ফেলে দিলে ই বিমল মিত্রের একটি গোটা বই হয়ে বেরিয়ে আসে।
--‘ বুঝলেন দীপাদি আমার পিসির ননদের ব্রেন টিউমার হয়েছে ।কোথায় দেখাবে বুঝতে পারছে না। ‘
--‘ কেন রে মানাসিক আঘাত পেয়েছিল বুঝি?’
ব্রেন টিউমারের সঙ্গে মানসিক আঘাতের কি সম্পর্ক বোঝা গেল না ।তবু বললাম—‘না সেরকম তো শুনিনি ।আপনার কি কোনও ডাক্তার চেনা জা না আছে?’  
সবচেয়ে বড়লোক দিদিমণি তাই তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করতে হয়। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ডাক্তার ,তাই এ বিষয়ে তার জ্ঞানের সীমা পরিসীমা নেই। ভাবখানা এমন নিজে ই একজন এম ডি ডাক্তার
--‘ঠিক আছে খবর নিয়ে তোকে জানাব’
--- ও পাস থেকে মধ্য বয়েশি অপালাদি দেখো বাপু ,দু/তিন জনের সঙ্গে কন্সালট কর। একজন ডাক্তারের ওপর ভরসা কোর না।আজকাল ডাক্তারদের  যা  অবস্থা পয়সা ছাড়া কিস্যু বোঝে না    
ইংরেজির শিরিন। –ভীষণ সমালোচ্‌ক,ভীষন বড়লোক – ফান্দামেন্তালিস্ত  বড়দির পো ধরা  ইংরেজির রুপালিদিকে বলল ,’রুপালিদি,স্লীভ লেস টপ ভাল কোথায় পাওয়া যায়।বলতে পারেন?’
সমস্ত স্টাফ রুমে সাঙ্গাতিক সংখ্যালঘু আমাদের শিরিন।তিরিশ ইসটু এক।   
কটা চোখ আরও কটা করে রুপাদি বললেন –‘আমার জানা নেই তোমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস  কর।শিরিনের বন্ধুরা  মানে আঠাশ   থেকে পইত্রিশ।শিরিন বুঝল ওষুদে ধরেছে।
সঙ্গে সঙ্গে অপাশ থেকে ঝাপিয়ে সবজান্তা অপালাদি -,কেন তোদের গড়িয়াহা্টার পান্টালুন্সে,ভিআইপি –র   বিগবাজার, ওয়েস্টসাইডে পাওয়া যায় না?,গড় গড় করে অনেক নাম  বলে গেলেন ।টপ একেবারে থরে থরে সাজান হয়ে গেল!
    আমাদের স্কুলের শোভা অপূর্ব। যেদিন ট্রেনে করে কলকাতা থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দুরত্তের আএই আধা মফশ্বল শহরে নেমেছিলাম  তখন ভাবিনি এমন মনোহরণ করা প্রকৃতি শোভিত একটি জায়গা দেখতে পাব। পাঁচ বিঘা জমির ওপরে –মনের মধ্যে যে  স্বপ্নের স্কুল   বাড়িটি সাজিয়ে রাখা ঠিক তেমনি ।কলকাতার স্কুল গুলো তিনতলা ,চারতলা,পাঁচতলা কতোগুলো পায়রার খোপ ।  
সদ্য পঞ্চাশ পেরনো স্কুলে অনেক গাছপালা –বেল,আম,সবেদা,অশোক ,কুরচি ,কৃষ্ণচূড়া, হরেক রকম জবা,রঙ্গন, --ইউকালিপটাস গাছের গা বেয়ে উঠেছে  সাদা, গোলাপি বোগান ভেলিয়া । বটগাছ ঘিরে পুকুর ।সুন্দর  দুটো সাজান বাগান ।শীতের দিনে চন্দ্রমল্লিকা,ডালিয়া,শোভিত হয়ে  থাকে। আমাদের বাহাদুর বাগান করায় ওস্তাদ ।এখানে দাঁড়ালে ই মনটা ভাল হয়ে যায়। 
                                  বড়দির ছায়াসঙ্গিনী নীলাদির কাজ হল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কে কি কথা বলছে নজরদারি করা আর তারপর টুক করে সেটা নিপুনভাবে  বড়দির কানে তুলে দেয়া ।বেশ বড়সড় স্থানীয় নেতার স্ত্রী।সব সময় সকলকে তটস্থ করে রাখা –কথায় কথায় ‘দিনকাল ভাল নয়  সামঝে চলতে হবে ,বুঝে শুনে কথা বলতে হবে’।ছাত্রিদের সঙ্গে কথা বলার সময় কৃত্রিম মধু ঝরে—‘বাবা,বাছা,মানু ,সোনা’-ইত্যাদি ছাড়া কথা বলেন না ।মিডিয়ার ভয়। যদিও দিনে চারটি  ক্লাস থাকলে অবধারিতভাবে দুটোতে জান।
আমাদের সুমিতা দি কলেজ জীবনে ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে  একটি প্রতিবাদী চরিত্র আছে। প্রশাসনের বিপরীতমুখী তাই আমাদের চোখের মনি।তাকে নিয়ে বড়দি একটু বিব্রত ছিলেন,বাচলেন ।সুমিতাদি পাশের স্কুলে হেডমিস্ট্রেস হয়ে চলে গেলেন।  
আজকাল প্রত্যকটি স্কুল এক একটি ঘুঘুর বাসা। তার ওপর মফঃস্বল চরিত্ররাজনীতির একটি প্রছন্ন ছায়া থেকেই যায়। বাঙালি জীবনের সঙ্গে রাজনীতি যে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে যেন ঘরকন্না করছে। দুটোকে আলাদা করা যায় না। একে অপরকে টাইট দেয়া এবং প্রছন্ন দাদাগিরি করা র লোভ বোধহয় কিছু লোকের থাকে আর তার থেকে যতো অনাসৃষ্টি। আর এতেই পরিবেশ দুষিত হয়ে ওঠে। যতদিন সুমিতাদি ছিলেন ততদিন আমরা সীমন্তিনিদিকে এড়িয়ে চলতাম বড়দির  শিষ্যা ভেবে ।আমাদের ধারনা যে কত ভুল ঘটনা পরম্পরা সেটা  প্রমানিত
করে দিল
এমতাবস্থায়  মিডিয়া ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো  ক্লাস রুমে দিদিমনিদের  মোবাইল ব্যবহার করা নিয়ে । তার সঙ্গে লিপস্টিক ফ্যাশান ইত্যাদি নিয়েও । ছাত্রদের শাসন করা অমার্জনীয় অপরাধ। দিদিমনি ,স্যারেরা হয়ে গেলেন ভিলেন। কোমল ভালবাসার সম্পর্কে এল সন্দেহ ।
অর্থ ই যখন সময়ের ধর্ম স্বর্গ পরমন্তপ সে সময়ে শিক্ষকের সম্মান টম্মমান এগুলো খেলো কথা । শিক্ষক-ছাত্র, ডাক্তার-রুগী এইসব সম্পর্ক নির্ধারণ করবে বাজার ।এমন খবর  বানাও যা বাজার খাবে –মাছের টোপের মত ।বাজার গরম হয়ে উঠল।
                                                       দিদিমনিরা সালওয়ার কামিজ পরবেন।মাহামান্য আদালত রায় দিলেন । মাষ্টার মশাইদের ধুতি থেকে প্যান্ট পরতে কোন আইন আদালতের শরনাপন্ন হতে হয়নি নদী পেরিয়ে ,খাল পেরিয়ে ,ট্রেন-বাস-ভ্যানরিক্সা চড়ে যে মেয়েটি আশি কিলোমিটার পাড়ি দেবে সে চেয়েছিল পোশাকের অধিকার ,সুবিধার্থেআপত্তির ঝড় উঠলো ।আদালত ,কোর্ট ,কাছারি করে একজন শিক্ষক অধিকার অর্জন করল সকলের জন্য  
কিন্তু মেয়ে স্কুলগুলোতে ই আপত্তির ঢেউ উঠলো বেশী ।মেয়েরই তো    সমাজের ঠিকাদার ।কাধে নিয়মের ভার নিয়ে নুয়ে পড়লেও আপত্তি নেই। এবার লড়াই, অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ের ।
                                      স্কুল থেকে ফেরার সময় শ্টেশনে ট্রেন ধরতে এসে চুপি চুপি সালওয়ার কামিজ পরার পরিকল্পনা করি।স্কুলে কথাটা পাড়লেই অনেকেই রে রে করে ছুটে আসেসর্বনাশ সমস্ত নৈতিকতার পতন হবে যে । এত পরিছন্ন সমাজের মুখে চুন কালি পড়বে যে।
চল্লিশ পেরনো সুমেরাদি ,দুই ইঞ্চি ব্লাউস পরেন ,শুনি তিনি লিপস্টিক ,মাস্কারা র ফিতে কেটেছিলেন স্কুলে ।তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে বড় গারজেন। বড়দির কাছে আনুমতি চাইলে বলেন ,”ছোট জায়গা তো ,মানুষের মন সেভাবে তৈরি হয়নি !” বুঝলাম ঘরে নয় সব জায়গায় একজন করে শাশুড়ি আছেন ।অথচ এইরকম ছোট জায়গায় আমাদের ছাত্রীরা নাকের ওপর দিয়ে যথেচ্ছ পোশাক পরে চলে যায়।
ফয়শালা হয়  না ,শুধু শিমন্তিনিদি আমাদের হয়ে বার বার বিভিন্ন যুক্তির আবতারনা করেন । স্টাফরুমে ছায়া ঘনায় ।কোনও বিপদে পড়লেই দিদির প্রছন্ন প্রশ্রয় আমরা পাই।   দিদির একটু     জোরে কথা বলা অভ্যেসসোজা কথা  সোজা ভাবে বলতে ই পছন্দ করেন,সোজা কথার সোজাসাপটা  জবাব ।তাতে আবার অনেকের চোখ টাটায় । ছোটদের মদত দিচ্ছে। ক্ষমতা লোভী, ক্ষমতা চায়। ছোটদের হাতে নিয়ে দল পাকাতে চাইছে । ছাত্রী দরদী দিদির সম্পর্কে রাতারাতি মত পাল্টে যায় ।
সুমি প্রথমদিন সালওয়ার কামিজ পরে আসে । গেল গেল রব উঠলো । আদালতের রায়, খুব বেশি কিছু করা গেল না । আমরা আরও একটু সাহসী হয়ে উঠলাম । একে একে গুটি গুটি ৭।৮ জন  এক দিন করে সালওয়ার কামিজ পরে আসতে লাগলাম । সালওয়ার কামিজ ও ক্ষমতা যেন সমার্থক হয়ে উঠল ।বিপ্লবীরা ক্ষমতা অর্জন করছে ।ক্ষমতাশালিরা শঙ্কিত হয়ে ওঠেন । চোখ রাঙ্গিয়ে চালাতে না পারার ভয় ।
সোমবার ক্লাস থেকে ফিরে দেখি ধামাধরা স্টাফ কাউন্সিল সেক্রেটারি তার অনুগতদের সঙ্গে ফিশফাশ করছেন । একজন গার্ডিয়ান সিমন্তিনিদির নামে চিঠি দিয়েছে ।তার মেয়েকে দিদি চড় মেরেছেন ও অশালীন গালিগালাজ করেছেন । সে অত্যন্ত গুছিয়ে গুছিয়ে গার্জিয়ান মেম্বার , সেক্রেটারি ও হেড মিস্ট্রেসকে চিঠি দিয়েছে । শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।পা মাটিতে আটকে গেল।
কুড়ি বছর ধরে শিক্ষকতা ,ছাত্রিদের অত্যন্ত প্রিয় দিদি । অসম্ভব ভাল গান করেন,নাচেন, লেখেন। স্কুলের কোন কালচারাল ফাংশন তাকে ছাড়া হয় না । বড়দির আজ্ঞায় চারদিনে ভানুসিংহের পদাবলি মঞ্চথ করান ।   নিজের মত প্রকাশে অটল, কখন ও পিছপা হন না ।তাই শত্রু অনেক ।  জীবনে অনেক টানাপোড়েনতা সত্তে ও মাথা উঁচু করে বাঁচেন ।
বড়দি দিদিকে ডেকে গার্জিয়ান দের মুখোমুখি বসিয়ে  আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন । দিদিকে অপমানিত হতে দেখে অনেকে উল্লসিত হয়ে উঠলেন । পৈশাচিক উল্লাসের নমুনা দেখে আমরা ‘থ’ হয়ে গেলাম। আমরা কি সত্যি শিক্ষিত ? ঝিকে মেরে বউ কে শাসন করা গেল । বেশ আত্ম পরিতৃপ্তি ক্ষমতাশিন দের। 
মিথ্যা বয়ান দেখে দিদি কথা হারিয়ে ফেললেন । গার্জিয়ান বলল “আপনার নামে ত অনেক কেচ্ছা আছে ।  কি করে আপনাকে সায়েস্তা করতে হই আমরা জানি। মিডিয়া আমাদের হাতে ।আপনাকে ঢিট করা আমাদের দু মিনিটের  কাজ ।
বড়দি নীরবশিক্ষিকারা মজা দেখছেন । গার্জিয়ান দুদিন তিনদিন এসে দিদিকে শাসিয়ে যায় । মাধ্যামিক ফেল গার্জিয়ান দের চোখ রাঙ্গানি দেখে আমরা সিটিয়ে থাকি। আমরা দগ্ধ হতে থাকি । আমাদের মধ্যে চাপান উতোর । আমি বললাম –‘আমি কিছুতে ই বিশ্বাস করিনা দিদি এরকম বলেছেন!। সাজানো ঘটনা । আমাদের কে চুপ করিয়ে রাখার নোংরা  খেলা । তার জন্য ধাপে ধাপে ক্রম, একটা নাটক গড়ে তোলা নিপুন চালে । ধন্য  রাজনীতি । দিদির মুখটায় কে যেন সাপের ছোবল দিয়েছে । মুখের দিকে তাকানো যায়না ।  আমাদের ভেতর কাঁদতে থাকে । অসহায়ভাবে ।
আমরা কিন্তু সালওয়ার কামিজ পরা ছাড়িনি । যদিও সংখ্যা কমে দুই এ এসে ঠেকেছে । সালওয়ার কামিজ একটি নমুনা মাত্র ।
এভাবে ই মানুষ মানুষকে ভেঙ্গে দেয় । রাজনীতির কুটিল গতি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে ঘুন ধরায় । মেরুদণ্ডের ভেতরে মজ্জায় সেই ঘুনপোকাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় –যা মানুষকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয় না । আমার পায়ের তলায় মাথা দাও নাহলে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে তলিয়ে যাও ।
                                 ----------------------

Saturday, 27 August 2011

ধ্রুবতারা

ধ্রুবতারা

by Nandita Bhattacharjee on Friday, August 26, 2011 at 10:29pm

অন্তহীন নক্ষত্রের ভিড়ে

দিবারাত্রির বৃত্তের আবর্তে

ধ্রুবতারা অকৃত্রিম

শাশ্বত লক্ষ্য।

আকাশের দিবারাত্রির কাব্যে

অনিমিখ অনির্বান

আহ্বান।

~~~~~~

Wednesday, 24 August 2011

চাকলা চল~~

by Nandita Bhattacharjee on Saturday, August 20, 2011 at 10:17pm


পরশু জন্মাষ্ঠমী।যশোর রোড ভেসে যাচ্ছে জনজোয়ারে।সাত থেকে সত্তর।স্রোতের মত এগিয়ে যাচ্ছে বাগবাজার থেকে চাকলা ।জয় লোকনাথাবাবার জয়।দুদিন ধরে দুপুর থেকেই যানযটে আধঘন্টার রাস্তা পেরোতে লাগছে দেড়ঘন্টা।রবিবারে তো কথাই নেই।ভাসবে মানুষ,রাস্তা হবে নিশ্চল।এ এক অদ্ভূত মাদকতা।কিসের টানে এমন ছুটে চলা!!শিয়ালদা ও হাওড়ায় প্রথম অবতরণ। ম্যাটাডর দাঁড়িয়ে থাকে।টপাটপ নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যস্থলে।মাছের টোপ ধরার মত।এছড়াও বিভিন্নদিক থেকে জড় হচ্ছে মানুষ পছন্দমত যানবাহনে করে।কিছুদিন আগেও যাওয়ার বাহন ছিল পদযুগল।বাগবাজার গঙ্গা থেকে বাঁকে করে জল নিয়ে আবার ছোটা। উদ্দাম নেশা।বাবা পার করেগা।রাস্তায় জলসত্রের আয়োজন জায়গায় জায়গায়।তার জন্যে কয়েকদিন ধরেই বাস থামিয়ে চাঁদা তোলা হয়েছে।জলসত্রের তাবুতে কেবলমাত্র জল নয় রাত্রিবাসেরও বন্দোবস্ত আছে।আছে খিচুড়ী।খাইয়ে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।পরিবেশনে মেয়েরা।মাইকে বাজছে 'শিলা কি জওয়ানী' বা গলা কাপিয়ে অনুপ জালোটা।বাবা কা মহিমা।বা হিন্দিগানের সুরে বাবার মহিমা কীর্ত্তন। এ ছাড়া জিতের সুরের নাচন তো আছেই।সারারাত উচ্চগ্রামে মাইক।সংগে রসনা রসসিক্ত উন্মাদ নৃত্য।পরিশ্রমের পর ধকল নামাতে হবে তো?সাত থেকে দশ পনের নতুন জামা,মাথায় লাল ফেট্টি।তাতে চকচকে সুতো লেখা জয় লোকনাথ।মধ্যবয়েসী মহিলারা পরেছেন নতুন শাড়ী।মাথায় ফেট্টি একইরকম। কিশোর যুবারা বারমুডা বা ধুতি।মাথায় কখনো ফেট্টির বদলে নতুন গামছা।কাঁধে বাঁক লাফাতে লাফাতে চলেছে। ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে।ম্যাটাড়রে নাচতে নাচতে এগিয়ে যাওয়া।কোথায় বা ধর্ম কোথায় বা ভক্তি।ফুর্তি ফুর্তিফুর্তি!হুজুগেরফোয়ারা।উন্মাদনার মিছিল।বাবার জন্মস্থানে পৌছে জল ঢেলে এ জন্মের পাপ স্খালন বা পরজন্মের মুক্তি।বা নেই কোন যুক্তি। চল চাকলা।রনে বনে জঙ্গলে যেথায় বিপদে পড়িবে বাবাকে স্মরণ করিবে। তাই সরল বিশ্বাসে একটি মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকের ইংরাজী পরীক্ষায় সমস্ত খাতা জুড়ে জয় লোকনাথ বাবার জয় লিখে এসেছিল ।ইংরাজী পরীক্ষা ফার্স্ট জেনারেশন ইংরাজী পড়ুয়াদের কাছে বিপদই বটে!!!ফল হয়েছিল একশতে শূণ্য।
বাবা কোথায় খাবি খাচ্ছেন কে জানে? এত ডাকাডাকি!!হেচকি উঠছে না তো? কি ভেইবতেছেন বাবা?