ঝাঁপতাল নন্দিতা ভট্টাচার্য্য
সীমন্তিনীদিকে প্রথম যেদিন স্কুলে দেখি তেমন কিছু মনে হয়নি।আস্তে আস্তে বেশ খারাপ ই লাগত। কট কট করে কথা বলে,ঝপ ঝপ করে উত্তর দেয়,হন হন করে হাটে। ওর হাটা নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে নকল করে দেখাতাম, গোপনে ।
তখন ছিলেন আমাদের সুমিতা দি,যার কথায় আমাদের ওঠা বসা,চলাফেরা।
স্কুলের বড়দি অল্প বয়সী ,সুলক্ষণাদি। লম্বায় ৫’৬” ।চেহারা মোটেই বড়দি সুলভ নয়।বেশ সুন্দরী। টিকলো নাক, ঠোঁটের ওপরে তিল, সিনেমার নায়িকাদের মত দেখতে। প্রধান দলের সমর্থক ।দলের সমস্ত গুন ই প্রকট। কি ভাবছেন তা বোঝা শিবের অসাধ্য ।মুহূর্তে গম্ভীর মুখটা হাসি হাসি করে ফেলেন। ডান হাতের খবর বা হাত জানতে পারে না ।খু-উ-ব গুছিয়ে গত বাধা কথা বলেন। ‘আপনি ,’ ‘আজ্ঞে’ ,’শুনছেন’,।তারপর সাঙ্গাতিক কথা কেমন নির্লিপ্ত মুখ করে বলে ফেলেন।শোনা যায় রাজনীতির সঙ্গে কোনোদিন ই তেমন যোগাযোগ ছিল না ।।প্রধান শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদেই রাজনীতির আঙ্গিনায় বাসা বাধা। কিছুদিনের মধ্যেই সুঅভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন। সহজ ভাবে নিদারুন সব নোটিশ পাঠান। হিটলারের ছোটবোন ।সংগ্রাম নয় বুদ্ধির দক্ষতায় সংগঠনের অনেক উঁচু ধাপে উঠে এসেছেন ।
স্কুলের স্টাফ রুম একটি ছোটখাটো চলমান এনস্লাইকপেডিয়া। ২০’*২০’ ঘরে পঁইত্রিশ জন শিক্ষিকার আবাসস্থল ।মাথার ওপর ফ্যান অর্ধেকের ওপর বন্ধ থাকে। বর্ষার দিনে ছাদ স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকে।
এ হেন ঘরের আড্ডায় যে কোনও বিষয় ফেলে দিলে ই বিমল মিত্রের একটি গোটা বই হয়ে বেরিয়ে আসে।
--‘ বুঝলেন দীপাদি আমার পিসির ননদের ব্রেন টিউমার হয়েছে ।কোথায় দেখাবে বুঝতে পারছে না। ‘
--‘ কেন রে মানাসিক আঘাত পেয়েছিল বুঝি?’
ব্রেন টিউমারের সঙ্গে মানসিক আঘাতের কি সম্পর্ক বোঝা গেল না ।তবু বললাম—‘না সেরকম তো শুনিনি ।আপনার কি কোনও ডাক্তার চেনা জা না আছে?’
সবচেয়ে বড়লোক দিদিমণি তাই তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করতে হয়। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ডাক্তার ,তাই এ বিষয়ে তার জ্ঞানের সীমা পরিসীমা নেই। ভাবখানা এমন নিজে ই একজন এম ডি ডাক্তার।
--‘ঠিক আছে খবর নিয়ে তোকে জানাব’
--- ও পাস থেকে মধ্য বয়েশি অপালাদি দেখো বাপু ,দু/তিন জনের সঙ্গে কন্সালট কর। একজন ডাক্তারের ওপর ভরসা কোর না।আজকাল ডাক্তারদের যা অবস্থা পয়সা ছাড়া কিস্যু বোঝে না ।
ইংরেজির শিরিন। –ভীষণ সমালোচ্ক,ভীষন বড়লোক – ফান্দামেন্তালিস্ত বড়দির পো ধরা ইংরেজির রুপালিদিকে বলল ,’রুপালিদি,স্লীভ লেস টপ ভাল কোথায় পাওয়া যায়।বলতে পারেন?’
সমস্ত স্টাফ রুমে সাঙ্গাতিক সংখ্যালঘু আমাদের শিরিন।তিরিশ ইসটু এক।
কটা চোখ আরও কটা করে রুপাদি বললেন –‘আমার জানা নেই তোমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস কর।শিরিনের বন্ধুরা মানে আঠাশ থেকে পইত্রিশ।শিরিন বুঝল ওষুদে ধরেছে।
সঙ্গে সঙ্গে অপাশ থেকে ঝাপিয়ে সবজান্তা অপালাদি -,কেন তোদের গড়িয়াহা্টার পান্টালুন্সে,ভিআইপি –র বিগবাজার, ওয়েস্টসাইডে পাওয়া যায় না?,গড় গড় করে অনেক নাম বলে গেলেন ।টপ একেবারে থরে থরে সাজান হয়ে গেল!
আমাদের স্কুলের শোভা অপূর্ব। যেদিন ট্রেনে করে কলকাতা থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দুরত্তের আএই আধা মফশ্বল শহরে নেমেছিলাম তখন ভাবিনি এমন মনোহরণ করা প্রকৃতি শোভিত একটি জায়গা দেখতে পাব। পাঁচ বিঘা জমির ওপরে –মনের মধ্যে যে স্বপ্নের স্কুল বাড়িটি সাজিয়ে রাখা ঠিক তেমনি ।কলকাতার স্কুল গুলো তিনতলা ,চারতলা,পাঁচতলা কতোগুলো পায়রার খোপ ।
সদ্য পঞ্চাশ পেরনো স্কুলে অনেক গাছপালা –বেল,আম,সবেদা,অশোক ,কুরচি ,কৃষ্ণচূড়া, হরেক রকম জবা,রঙ্গন, --ইউকালিপটাস গাছের গা বেয়ে উঠেছে সাদা, গোলাপি বোগান ভেলিয়া । বটগাছ ঘিরে পুকুর ।সুন্দর দুটো সাজান বাগান ।শীতের দিনে চন্দ্রমল্লিকা,ডালিয়া,শোভিত হয়ে থাকে। আমাদের বাহাদুর বাগান করায় ওস্তাদ ।এখানে দাঁড়ালে ই মনটা ভাল হয়ে যায়।
বড়দির ছায়াসঙ্গিনী নীলাদির কাজ হল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কে কি কথা বলছে নজরদারি করা আর তারপর টুক করে সেটা নিপুনভাবে বড়দির কানে তুলে দেয়া ।বেশ বড়সড় স্থানীয় নেতার স্ত্রী।সব সময় সকলকে তটস্থ করে রাখা –কথায় কথায় ‘দিনকাল ভাল নয়। সামঝে চলতে হবে ,বুঝে শুনে কথা বলতে হবে’।ছাত্রিদের সঙ্গে কথা বলার সময় কৃত্রিম মধু ঝরে—‘বাবা,বাছা,মানু ,সোনা’-ইত্যাদি ছাড়া কথা বলেন না ।মিডিয়ার ভয়। যদিও দিনে চারটি ক্লাস থাকলে অবধারিতভাবে দুটোতে জান।
আমাদের সুমিতা দি কলেজ জীবনে ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে একটি প্রতিবাদী চরিত্র আছে। প্রশাসনের বিপরীতমুখী তাই আমাদের চোখের মনি।তাকে নিয়ে বড়দি একটু বিব্রত ছিলেন,বাচলেন ।সুমিতাদি পাশের স্কুলে হেডমিস্ট্রেস হয়ে চলে গেলেন।
আজকাল প্রত্যকটি স্কুল এক একটি ঘুঘুর বাসা। তার ওপর মফঃস্বল চরিত্র । রাজনীতির একটি প্রছন্ন ছায়া থেকেই যায়। বাঙালি জীবনের সঙ্গে রাজনীতি যে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে যেন ঘরকন্না করছে। দুটোকে আলাদা করা যায় না। একে অপরকে টাইট দেয়া এবং প্রছন্ন দাদাগিরি করা র লোভ বোধহয় কিছু লোকের থাকে আর তার থেকে যতো অনাসৃষ্টি। আর এতেই পরিবেশ দুষিত হয়ে ওঠে। যতদিন সুমিতাদি ছিলেন ততদিন আমরা সীমন্তিনিদিকে এড়িয়ে চলতাম বড়দির শিষ্যা ভেবে ।আমাদের ধারনা যে কত ভুল ঘটনা পরম্পরা সেটা প্রমানিত
করে দিল
এমতাবস্থায় মিডিয়া ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো ক্লাস রুমে দিদিমনিদের মোবাইল ব্যবহার করা নিয়ে । তার সঙ্গে লিপস্টিক ফ্যাশান ইত্যাদি নিয়েও । ছাত্রদের শাসন করা অমার্জনীয় অপরাধ। দিদিমনি ,স্যারেরা হয়ে গেলেন ভিলেন। কোমল ভালবাসার সম্পর্কে এল সন্দেহ ।
অর্থ ই যখন সময়ের ধর্ম স্বর্গ পরমন্তপ সে সময়ে শিক্ষকের সম্মান টম্মমান এগুলো খেলো কথা । শিক্ষক-ছাত্র, ডাক্তার-রুগী এইসব সম্পর্ক নির্ধারণ করবে বাজার ।এমন খবর বানাও যা বাজার খাবে –মাছের টোপের মত ।বাজার গরম হয়ে উঠল।
দিদিমনিরা সালওয়ার কামিজ পরবেন।মাহামান্য আদালত রায় দিলেন । মাষ্টার মশাইদের ধুতি থেকে প্যান্ট পরতে কোন আইন আদালতের শরনাপন্ন হতে হয়নি ।নদী পেরিয়ে ,খাল পেরিয়ে ,ট্রেন-বাস-ভ্যানরিক্সা চড়ে যে মেয়েটি আশি কিলোমিটার পাড়ি দেবে সে চেয়েছিল পোশাকের অধিকার ,সুবিধার্থে। আপত্তির ঝড় উঠলো ।আদালত ,কোর্ট ,কাছারি করে একজন শিক্ষক অধিকার অর্জন করল সকলের জন্য
কিন্তু মেয়ে স্কুলগুলোতে ই আপত্তির ঢেউ উঠলো বেশী ।মেয়েরই তো সমাজের ঠিকাদার ।কাধে নিয়মের ভার নিয়ে নুয়ে পড়লেও আপত্তি নেই। এবার লড়াই, অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ের ।
স্কুল থেকে ফেরার সময় শ্টেশনে ট্রেন ধরতে এসে চুপি চুপি সালওয়ার কামিজ পরার পরিকল্পনা করি।স্কুলে কথাটা পাড়লেই অনেকেই রে রে করে ছুটে আসে। সর্বনাশ সমস্ত নৈতিকতার পতন হবে যে । এত পরিছন্ন সমাজের মুখে চুন কালি পড়বে যে।
চল্লিশ পেরনো সুমেরাদি ,দুই ইঞ্চি ব্লাউস পরেন ,শুনি তিনি লিপস্টিক ,মাস্কারা র ফিতে কেটেছিলেন স্কুলে ।তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে বড় গারজেন। বড়দির কাছে আনুমতি চাইলে বলেন ,”ছোট জায়গা তো ,মানুষের মন সেভাবে তৈরি হয়নি !” বুঝলাম ঘরে নয় সব জায়গায় একজন করে শাশুড়ি আছেন ।অথচ এইরকম ছোট জায়গায় আমাদের ছাত্রীরা নাকের ওপর দিয়ে যথেচ্ছ পোশাক পরে চলে যায়।
ফয়শালা হয় না ,শুধু শিমন্তিনিদি আমাদের হয়ে বার বার বিভিন্ন যুক্তির আবতারনা করেন । স্টাফরুমে ছায়া ঘনায় ।কোনও বিপদে পড়লেই দিদির প্রছন্ন প্রশ্রয় আমরা পাই। দিদির একটু জোরে কথা বলা অভ্যেস।সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে ই পছন্দ করেন,সোজা কথার সোজাসাপটা জবাব ।তাতে আবার অনেকের চোখ টাটায় । ছোটদের মদত দিচ্ছে। ক্ষমতা লোভী, ক্ষমতা চায়। ছোটদের হাতে নিয়ে দল পাকাতে চাইছে । ছাত্রী দরদী দিদির সম্পর্কে রাতারাতি মত পাল্টে যায় ।
সুমি প্রথমদিন সালওয়ার কামিজ পরে আসে । গেল গেল রব উঠলো । আদালতের রায়, খুব বেশি কিছু করা গেল না । আমরা আরও একটু সাহসী হয়ে উঠলাম । একে একে গুটি গুটি ৭।৮ জন এক দিন করে সালওয়ার কামিজ পরে আসতে লাগলাম । সালওয়ার কামিজ ও ক্ষমতা যেন সমার্থক হয়ে উঠল ।বিপ্লবীরা ক্ষমতা অর্জন করছে ।ক্ষমতাশালিরা শঙ্কিত হয়ে ওঠেন । চোখ রাঙ্গিয়ে চালাতে না পারার ভয় ।
সোমবার ক্লাস থেকে ফিরে দেখি ধামাধরা স্টাফ কাউন্সিল সেক্রেটারি তার অনুগতদের সঙ্গে ফিশফাশ করছেন । একজন গার্ডিয়ান সিমন্তিনিদির নামে চিঠি দিয়েছে ।তার মেয়েকে দিদি চড় মেরেছেন ও অশালীন গালিগালাজ করেছেন । সে অত্যন্ত গুছিয়ে গুছিয়ে গার্জিয়ান মেম্বার , সেক্রেটারি ও হেড মিস্ট্রেসকে চিঠি দিয়েছে । শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।পা মাটিতে আটকে গেল।
কুড়ি বছর ধরে শিক্ষকতা ,ছাত্রিদের অত্যন্ত প্রিয় দিদি । অসম্ভব ভাল গান করেন,নাচেন, লেখেন। স্কুলের কোন কালচারাল ফাংশন তাকে ছাড়া হয় না । বড়দির আজ্ঞায় চারদিনে ভানুসিংহের পদাবলি মঞ্চথ করান । নিজের মত প্রকাশে অটল, কখন ও পিছপা হন না ।তাই শত্রু অনেক । জীবনে অনেক টানাপোড়েন । তা সত্তে ও মাথা উঁচু করে বাঁচেন ।
বড়দি দিদিকে ডেকে গার্জিয়ান দের মুখোমুখি বসিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন । দিদিকে অপমানিত হতে দেখে অনেকে উল্লসিত হয়ে উঠলেন । পৈশাচিক উল্লাসের নমুনা দেখে আমরা ‘থ’ হয়ে গেলাম। আমরা কি সত্যি শিক্ষিত ? ঝিকে মেরে বউ কে শাসন করা গেল । বেশ আত্ম পরিতৃপ্তি ক্ষমতাশিন দের।
মিথ্যা বয়ান দেখে দিদি কথা হারিয়ে ফেললেন । গার্জিয়ান বলল “আপনার নামে ত অনেক কেচ্ছা আছে । কি করে আপনাকে সায়েস্তা করতে হই আমরা জানি। মিডিয়া আমাদের হাতে ।আপনাকে ঢিট করা আমাদের দু মিনিটের কাজ ।
বড়দি নীরব ।শিক্ষিকারা মজা দেখছেন । গার্জিয়ান দুদিন তিনদিন এসে দিদিকে শাসিয়ে যায় । মাধ্যামিক ফেল গার্জিয়ান দের চোখ রাঙ্গানি দেখে আমরা সিটিয়ে থাকি। আমরা দগ্ধ হতে থাকি । আমাদের মধ্যে চাপান উতোর । আমি বললাম –‘আমি কিছুতে ই বিশ্বাস করিনা দিদি এরকম বলেছেন!। সাজানো ঘটনা । আমাদের কে চুপ করিয়ে রাখার নোংরা খেলা । তার জন্য ধাপে ধাপে ক্রম, একটা নাটক গড়ে তোলা নিপুন চালে । ধন্য রাজনীতি । দিদির মুখটায় কে যেন সাপের ছোবল দিয়েছে । মুখের দিকে তাকানো যায়না । আমাদের ভেতর কাঁদতে থাকে । অসহায়ভাবে ।
আমরা কিন্তু সালওয়ার কামিজ পরা ছাড়িনি । যদিও সংখ্যা কমে দুই এ এসে ঠেকেছে । সালওয়ার কামিজ একটি নমুনা মাত্র ।
এভাবে ই মানুষ মানুষকে ভেঙ্গে দেয় । রাজনীতির কুটিল গতি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে ঘুন ধরায় । মেরুদণ্ডের ভেতরে মজ্জায় সেই ঘুনপোকাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় –যা মানুষকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয় না । আমার পায়ের তলায় মাথা দাও নাহলে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে তলিয়ে যাও ।
----------------------
No comments:
Post a Comment