Monday 29 August 2011

এখন তখন


মি-----তিন’,দূর থেকে দূরভাষ শুনতে পেল মিতিন।পলার গলা ।সেরকমই সুরেলা ও ন্যাকা ন্যাকা।অনেকদিন আগের পাহাড়ঘেরা ,গাছ গাছালি পরিবেষ্টিত ইউনিভার্সিটি –র গাছ পালার ফাঁক দিয়ে যেন শব্দটা কানে এসে পৌছল।মনে হছিল সে আর গাড়িয়াহাটের একরাশ পথ-পরিক্রমার ক্লান্তি ও জনাকীর্ণ হাঁসফাঁসের মধ্যে দাড়িয়ে নেই।দাড়িম্ব বকুলের মায়াঝরা আবিলতার বাতাস ওর কানে ও চুলে হাত বুলিয়ে গেল।
--‘কি রে অমন উপচে উপচে কোথাই চলেছিস?’
                                            ক –তদিন পর ,বোধহয় আট বৎসর –না –মাঝে একবার   একবার পলকের জন্য দেখা হয়েছিল দুই প্রিয় সখির ।দমদম এয়ারপোর্ট এমিতিন গিয়েছিল ছোট বোন কে তুলেদিতে আর পলা যাচ্ছিল বম্বে ।পড়ার দিনগুলো প্রায় পনের  বছর আগে ,তারপর পলা নিউইয়র্ক আর মিতিন কলকাতার ভাঙ্গা দেয়ালে ।ভাঙ্গাচোরা যখন চূড়ান্ত সেই সময় ই পলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আর তারপর এই ।
--‘তা চেহারা ছবিখানা ত সেরকম ই রেখেছ ।তেমনি ই আছ ,ঝকঝক করছ।তা লেডি প্রমিথিউসএর খবর কি?’—মাথা থেকে পা পর্যন্ত জরিপ করে  এই প্রশ্ন।
-‘লেডি প্রমেথিউস নই রে ,শৃঙ্খলিত ,completely bounded by the chain.
--ও তাই !!সেটা আবার কি?,-পলার চোখ কপালে!
--,সুখ, সুখ ,সুখের পাখী অনেক দূর নয়হাতের কাছে ,একেবারে হাতের মুঠোয় !’চোখে মুখে কৌতুক মিতিনের দুষ্টুমি ভরা চোখ
--‘ধরতে পেরেছিস তাহলে? পলা ও যথেষ্ট সজীব
-‘বোধহয়!’মিতিনের রহস্যময় জবাব
---‘সেকিরে !তুই তো তাহলে যাদুকর
--‘যাদুকর নই রেপ্রভাত সূর্যের লাল বলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে আর কষ্ট হয় নাঅপলকে তাকিয়ে থাকতে পারিআর তাতে ই সুখকে ধরতে পেরেছিলেকের জলে,গাছের পাতায় ,হিমেল বাতাসে,পরীর ঘুর্ণীতে,মাহারানির পুকুরের তির্যক আলোর খেলায় ,’—কেমন হারিয়ে যাওয়া গলায় বলল মিতিন
--ওখানে সুখ কিনতে পাওয়া যায় বুঝি?’—পলা তার আয়ত চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল
মিতিনের হেঁয়ালি পলাদের আবিষ্ট করে রাখতসেই মিতিন!!এমন বন্ধু  এ জীবনে আর  হল নাযার প্রতি স্নেহ মাখা প্রশ্রয় সকলের ছিলতার মিষ্টি স্বভাবের জন্য
বৈপরীত্য ছিল মিতিনের স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য আর এ জন্য ই ওর চরিত্রে  অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য ছিলযার দীপ্তিতে যে একবার তার কাছে এসেছে,সে আর সরতে পারেনি হই হই করে কবিতা পড়া কোনও নতুন বই বেরোলে চাঁদা তুলে কিনে বিকেলে পাণ্ডুলিপির আসরে সেটা চেঁচিয়ে পড়া পাণ্ডুলিপিহাতে লেখা লিটল ম্যাগাজিন,ছাপাবার পয়সা ছিল না মিতিন কবিতাই লিখত বেশি হঠাৎ একটা ছোটোগল্প লিখে হই চই ফেলে দিয়েছিল।  প্রান ছিল ওর আসল সৌন্দর্য্যআবার কখন ও কখনো গভীর বিষণ্ণতা ওকে আচ্ছন্ন করে রাখত। একবার ওরা সমুদ্রে বেড়াতে গিয়েছিল,তিনদিন মিতিন কোনও কথা বলে নি।দেখি ব্যলকনিতে বসে এক দৃষ্টে সামুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।
-‘কি রে আমরা সবাই চানে যাচ্ছি,যাবি না?’
---‘ তোরা  যা’—বলে হাটতে হাটতে বিচের বেলাভুমির কাছের আকাশ ছোঁয়া গাছ গুলোর মধ্যে  হারিয়ে গেল। কিন্তু সেজন্য আমরা মিতিন কে কখনও ভুল বুঝিনি।অর অদ্ভুত রস নিষিক্ত মণটাকে আমরা ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম।
-‘হেঁয়ালি ছেড়ে বলনা কোথায় আছিস?কি করছিস?’ভীষন বন্ধু হলেও দুজন দুই প্রান্তে থাকায় যোগাযোগ বিছিন্ন।মেয়েদের বন্ধুত্ব পদ্মপাতায় জল।বিয়ের পর নব জন্ম- অন্যের কথায় চলা ,অন্যের কথায় বলা ।যাদেরকে দিনান্তে একবার না দেখলে প্রহর ব্যর্থ হয়ে যেত তারা আজ দিনান্তে মনের কোনে একবার উঁকি  পর্যন্ত দেয় না
-‘এখন শুধু পোস্টমর্টেম হচ্ছি ।পৃথিবীর চোখে চুলচেরা নিক্তিতে মাপা হচ্ছে আমায় কক্ষচ্যুত গ্রহ হিসেবের খাতায় স্থান পাচ্ছে না। দোষী যখন সাব্যস্ত হয়েছি তখন পরীক্ষা দিতে হবে ত পদে পদে ।পাঁচিল দেয়া নেই ত! বেড়াহীন গাছ ত।তাকে ইচ্ছে মত ডাল ছেঁটে দেয়া যায়।এই ত জীবন। দীর্ঘ  সাংলাপ বলে মাথানিচু করল মিতিন। চোখ কি একটু ছলোছলো!
এ আবার কোন মিতিন?-ওর এ কোন স্বর শুনতে পাচ্ছে পলা!সেই উচ্ছ্বাস ভরা  ঝকঝকে সুরটা কোথায় হারিয়ে গেল?সুর –হ্যাঁ সুর –ভীষণ ভালো গান গাইতে পারত মিতিন।বোধহয় গান টা ধরে রাখলেই  একটা কিছু হত। ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর সে পাট আর রাখে নি। মিষ্টি গলা ।যে কোন গান চট করে গলায় তুলে নিতে পারত। কোন গানের কোন জায়গায় সুরে  আঁটকে গেছি ,-চল মিতিনের কাছে ইউনিভার্সিটির কমন রুমে কত গান যে ওর কাছ থেকে তোলা তার আর ইয়ত্তা নেই।আরেক গায়িকা বান্ধবী রীতা ও মিতিনের যৌথ প্রচেষ্টায় কমনরুমে মাঝে মাঝে বসে  যেত জলসা অদ্ভুত যত পরিকল্পনা ওর মাথায় এসে উদয় হত। হঠাৎ একদিন ঠিক হল ব্রহ্মপুত্রের কোলে নৌকায় কবিতা পাঠের আসর বসাতে হবে।যেমন ভাবা তেমন কাজ। অন্তত পক্ষে দুটো করে কবিতা সকলের পড়তে হবে।স্বরচিত হোক বা অন্যের  রচিত  হোক। ওর অনেক চেলা চামুণ্ডা ছিল- যারা ওর এইসব হুজুগের সঙ্গী ও আয়জক।
--‘জানিস তোদের মিতিন এখন আর হুজুগে মাতে না যখন তখন। খটখটে তার স্বভাব ।ছায়াযুদ্ধ চলছে তার মধ্যে ।অন্ধগলিতে রাস্তা খুঁজে মরছে সে ।কন পথ দিয়ে গেলে সে আলোর সরল রেখা সে ছুঁতে পারবে তার চেষ্টা চলছে নিয়ত। আমার কি এমন হওয়ার কথা ছিল রে? ’মনে হল যেন এই কথা গুলো বলার লোক সে পাচ্ছে না।ঝরনার মত ঝর ঝর করে বেরিয়ে আসছে অনেকদিনের  অবরুদ্ধ কথা।শুধু অপেক্ষায় একটি ভগিরথের।তখন ও পর্যন্ত কি জানি না কি এমন ঘটেছে ?শুধু মাঝে মধ্যে আভাস পাচ্ছি খনও আভিব্যক্তিতে কখনও কথার আলটপকা মন্তব্যে ।ওর কথা শুনে ভেতর টা কেমন আকুল হয়ে উঠলো ।যেন রাতচরা পাখী ।মনে হল এই সুরে কখন কথা বলতে শুনিনি ।বড্ডও আভিমান ও  আত্মসম্মানবোধ ছিল ওর।
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না ওকে।মনে হচ্ছিল যেন ক্লান্ত এক পাহাড়ের ধারে এসে দাঁড়িয়েছি আমি।পাশে অনেক নিচুতে খাদ ।আমি একদম খাঁদের পাশে। অপেক্ষা করছি তালিয়ে যাবার জন্য।একট  সীমারেখা এক ধাক্কা দিলে পড়ে যাবদুরে আকাশে কাল মেঘ,ঘনায়মান।জমাটবাধা ।অঝোরে ঝরে পড়বার প্রাক মুহূর্ত।
মিতিন কে আর একা ছাড়তে সাহস পেলাম না।গাড়িয়াহাট থেকে ওর সঙ্গে ওর  সল্টলেকের বাড়ীতে এলাম।সল্টলেকে ওর এক রুমের ফ্ল্যাট। মনে পড়ছিল ওদের বাড়ি ও বাড়ির জমজমাট দুর্গা পুজার কথা।মনের মধ্যে অসম্ভভ এক আকুলতা।ভেতরটা মোচড় দিচ্চে, ওর কথা জানার জন্য ভেতরটা পুড়ছে ।
                                               মেঝেতে বসে ওর মেয়ে একমনে ছবি আঁকছে।  বড় একটি পাহাড় সূর্য উঠছে, সামনে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। একাকী একটি নারী,  শিশুটি হাতে ।
তখনও পুরো আঁকা হয়নি । সবটাই  এলোমেলো। অবুঝ ভাবনার খেলা,অপটু হাতের রং-মশাল । আমি আস্তে আস্তে ওর মেয়ের পিঠে হাত রাখলাম।
                                        ------------------

1 comment: