ছেলেবেলা~~কোথায় গেলা?
আমাদের ছিল কাপড়ের পুতুল -নিজে বানাতাম। পুতুল বানানোর কায়দাটিও ছিল মজার।চারকোনা পুরণো নরম ধুতির টুকরো ,মাথাটি তুলো দিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে গোল করে নেয়া হতো। ঝ্যাটার কাঠি ভেঙ্গে কাপড় পেঁচিয়ে তৈরী হত হাত। এরপর সেই কাঠি হাত গলার সঙ্গে সুতো দিয়ে জোর জুড়ে দেয়া। এবার চুল। কাল ক্রসেটের এক গুচ্ছ সুতো কেটে অথবা মায়ের ট্যাসেল কেটে তার থেকে যতটা প্রয়োজন সেলাই করে জুড়ে দিতাম। এলো চোখ মুখের পালা । কাল সুতো দিয়ে চোখ ভুরু নাক,ঠোঁট ও টিপ লাল সুতো দিয়ে । হাতে ও গলায় ছোট ছোট পুঁতি দিয়ে মালার ও চুড়ি। কত চারুকলা। তারপর পাশের বাড়ীর বড়পিসীর কা...ছে ছুট্টে গিয়ে শাড়ী জামা বানাবার জন্যে টুকরো কাপড় চেয়ে আনতাম।বড়পিসী সেলাইয়ের কাজ করতেন তাই তার কাছে অনেক ছিট কাপড় থাকত।খুব সংগ্রামী জীবন ছিল তার।আমরা কোন কিছু চাইলে খুব খুশী হতেন।বড়পিসীর মেয়ে খুকুদির খুব অসুখ করেছিল,হাসপতালে ভর্তি। পাড়ার সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা গিয়ে রাতে থাকতেন হাসপাতালে। স্বামী পরিত্যক্তা বড়পিসীর গায়ে আঁচ লাগতে দিল না কেউ। খুকুদি সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরল।এমনই ছিল মধুর সম্পর্ক।
এল শীতের দিনে উল কাটা নিয়ে বসে যেতাম পুতুলের সুয়েটার বানাতে।তারপর মেলা থেকে ছোট খাট কিনে এনে বালিস তোষক সব নিজের হাতে বানানো চলত।সব সুঁচ সুতো নিয়ে হাতে সেলাই ।তরপর এল সেই পরম লগন পুতুলের বিয়ে।বন্ধু মালার ছেলে আমার মেয়ে।বড়পিসীর কাছ থেকে বায়না করে বেনারসীর টুকরো যোগাড় করে ফেল্লাম।চুমকী দিয়ে ব্লাউস ওড়না তৈরী হল। পাতাবাহারের পাতা দিয়ে কুঞ্জ তৈরী হল।মা জ্যেঠিমারা লুচি বানালেন।কি সমারোহ।১০ মত বন্ধুর নেমতন্ন।তারপর তো চোখের জলে কনে বিদায়।তখন হঠাৎ মনে হল আরে এ সব ই তো বন্ধুর বাড়ী চলে যাবে।পরদিন গিয়ে কোন এক ফাঁকে পাত্র পাত্রী দুজনকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে আসা।বন্ধু মালা কি আর ছেড়ে দেয়?পনসামগ্রী ওপাত্র পাত্রীর দাবী নিয়ে কদিন চলে রাম রাবনের যুদ্ধ-তারপর আবার বর ও কনে যার যার মা বাবার কাছে ফেরত।
আর একটি ভাল লাগার পর্ব ছিল রান্না বাটি খেলা। মেলা থেকে আসত ছোট ছোট হাড়ি কুরি। উঠোনের কোন এক কোনা য়ক গর্ত খুড়ে তৈরি হত উনুন । তারপর মুলতই পাতালতা দিয়ে সব রান্নার সরঞ্জাম ব্যঞ্জন বানান। অনেক সময় সত্যি সত্যি আগুন জ্বেলে অল্প জলে রান্না ও হত। এক একটি রান্নার জন্য এক রকম পাতা। কোনটি নাম জানা কোনটি অজানা ।
মহা আনন্দের ব্যপার ছিল স্কুল থেকে ফিরে এসে খেলতে যাওয়া ।আমরা বলতাম দাড়িয়া বান্দা খেলা। কোনমতে মুখে ভাত গুজে দৌড় মাঠে। মুখার্জী জেঠুদের মাঠ সবার মাঠ।আমার মাঠে আমিই খেলব সেই মনভাব তখনও তৈরি হয়নি। ছেলে মেয়ে মিলে খেলা। মাঝে মাঝে ঝগড়া আবধারিত। তখন আবার ছেলের দল মেয়ের দল আলাদা ।শুরু হত মেয়েলি খেলা- বুড়ি কুত কুত । শীতের দিনে ব্যাডমিন্টন । কারোকে বলে দিতে হত না ।একটার পর একটা পর পর তৈরি।মাঝে মাঝে খেলতে খেলতে হুঁশ থাকতো না ।সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলে জুটত উত্তম মধ্যম ।সন্ধ্যে ছিল একটি লক্ষন রেখা। সেটি পেরিয়ে যাওয়া মানে ই -হয়ে গেল। তবে খেলার জন্য সে টুকু আর কিছু মনে হত না। অন্ধকারে ছোড়দা ও আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন বাবা। ছোড়দাও আমার খেলার সঙ্গী।সুতরাং মারের ও সঙ্গী। কিছুক্ষন পর ঠাকুমা গিয়ে চুপি চুপি ভেতরে নিয়ে এলেন।বললেন,"বাবার কথা শুনবে"।হয়ে গেল শাসন। ঠাকুমার মুখের ওপরে বাবা কিছু বলবেন না জানি। সুতরাং আমাদের পায় কে।খেলার খেলা হল বকুনি থেকে বাঁচলাম।
আর আমরা অপেক্ষা করতাম বিহুর জন্য। কারন সেদিন কলার পাছালি ও বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি করে হত পিকনিক। সবচেয়ে মজা হত সেদিন পেঁয়াজ খাওয়া যাবে । বাড়ীতে পেঁয়াজ রশুন বারণ । সুতরাং সেই অমৃতের স্বাদ সেদিন পাওয়া যাবে।ভাবলে এখন হাসি পায়। নগদ টাকা পয়সার কোন ব্যপার নেই। চাল ডাল,ডিম-যা দরকার সবই চেয়ে চিন্তে সবার বড়ী থেকে যোগাড় হত।সাররাত সেখান থাকা ।তবে এতোটা হত না।রাত ১২টা নাগাত ঘরে ফেরা । পরদিন ভোর বেলা চান করে ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হত। সেখানে দাড়িয়ে আগুন পোহানো ।মা- জ্যেঠিমা -কাকিমারা রাত জেগে পিঠে বানাতেন ।কারন সেটা ছিল পৌষ সক্রান্তির আগের রাত। পরদিন ছিল মহা খাওয়ার ধুম।
এভাবে ই টিভি, কম্পিউটার গেম ,ফাস্ট ফুড, শপিং মল বিহনে আমাদের জীবন ছিল।
আজকালকার বাচ্চারা কোথায় আর এত সময় পায়।ইদুর দৌড় , কোচিং ,হ্যেনা শেখা, ত্যানা শেখা ,তারপর চাঁদ ধরার প্রতিযোগিতা। টুং সোনাদা ঘুম -এর দেশ থেকে অনেক দু--র। কষ্ট পাই ওদের জন্য।ব্যবধান টা বড় বেশি হয়ে গেছে। ছুঁতে পারিনা ওদের!!
No comments:
Post a Comment